বগুড়া শহরের খান্দার এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। জানালেন তার এলাকায় সপ্তাহেতো দূরের কথা তিন মাসেও একবার মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয় না। দিন-রাত যেকোনো সময় মশার যন্ত্রণায় টেকা দায়।
Advertisement
শহরের কারমাইকেল সড়কের কৃষি ফার্মের সামনে পৌরসভার একটি ময়লা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন রয়েছে। সারাদিন সেখানে ময়লা পড়ে। এর আশপাশে আবাসিক ভবন রয়েছে অনেকগুলো।
সেখানকার একটি ভবনের বাসিন্দা গৃহবধূ সেলিনা বেগম জানান, দিনেও মশারি টাঙাতে হয়। এর ওপর ময়লার গন্ধে টেকা যায় না। অপরিষ্কার এই জায়গাটির কারণে মশার উৎপাত ১০ গুণ বেশি। সেখানে ডাবের খোসা থেকে শুরু করে নানা রকম বাসনপত্রও পড়ে থাকে। পানি জমে মশার প্রজনন খুবই সহজ।
শহরের অপরপ্রান্ত মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা মীর ফরিদ হোসেন বলেন, কয়েল কিনতে কিনতে অস্থির হয়ে গেছি। মশার উৎপাত আগে কখনো এত বেশি হয়নি। একেতো ডেঙ্গু আতঙ্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তার ওপর এত মশা। পৌরসভার দায়িত্বরতরা কেন যে এসব দেখে না বুঝি না। আমরা খুব অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি।
Advertisement
শহরের ফুলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা অনিন্দ কুমার বলেন, পৌরসভার মশকনিধন অভিযান দৃশ্যমান নয়। একদিন শুধু মাইকিং শুনেছি, তারা ডেঙ্গু বিস্তারে জনগণকে সতর্ক হতে বলছে। এতেই শেষ। ড্রেনগুলো দেখলে ভয় লাগে। সেখানে মশা গিজগিজ করছে। কবে যে পৌরসভা ওষুধ ছিটিয়েছে মনে নেই।
প্রায় দেড়শো বছরের পুরোনো বগুড়া পৌরসভায় এখন ২১টি ওয়ার্ড রয়েছে। নতুন করে যুক্ত হওয়া ৯টি ওয়ার্ডে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ বাসিন্দাদের। মশা নিধনে পৌরসভার উদ্যোগ নিয়ে একই অভিযোগ করছেন তারা।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফুলদীঘি এলাকার বাসিন্দা রাকিব হোসেন বলেন, এ এলাকায় কখনো মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। পাশের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ওষুধ ছিটিয়ে চলে যায়। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হয়ে রয়েছি।
বগুড়া স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এডিস মশার প্রকোপে সারাদেশের মতো ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে বগুড়ায়ও। গত চার মাসে এই জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩৬। দুজন মারা গেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।
Advertisement
বগুড়ার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এখন জ্বর হলেই ডেঙ্গু সন্দেহে হাসপাতালে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের (কিট) সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালগুলোতে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। বর্তমানে বগুড়া মেডিকেল ও মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। বুধবার (১৯ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার (২১ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় ১৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর এ পর্যন্ত মারা গেছেন দুজন।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (শজিমেক) সহকারী পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, বগুড়া শহর ও গ্রামের মানুষ জ্বর হলেই হাসপাতালে ছুটে আসছে। তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের। এরই মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালে।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর সময়কাল এগিয়ে এসেছে ও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
বগুড়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় ৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও চার লাখেরও বেশি জনগোষ্ঠীর এ পৌরসভায় বছরে ১৫০ লিটার মশার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ২১টি ওয়ার্ডে এসব ওষুধ ছিটাতে ফগার মেশিন আছে ২৪টি। মশকনিধনের কাজে পৌরসভায় তিনজন স্থায়ী কর্মচারীও রয়েছেন।
পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শক শাহ আলী খান বলেন, প্রতি মাসে একটি ওয়ার্ডে ওষুধ বরাদ্দ দেওয়া থাকে দেড় লিটার। আর এই ওষুধ প্রয়োগের জন্য ওয়ার্ডপ্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০০ লিটার ডিজেল ও ২৫ লিটার অকটেন।
বর্ধিত এলাকা অর্থাৎ নতুন সংযুক্ত ওয়ার্ডগুলোতে মশার ওষুধ প্রয়োগ করা হয় না বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ জানালে শাহ আলী বলেন, শহরে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপার কার্যালয়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ওষুধ একটু বেশি দেওয়া হয়। বর্ধিত ওয়ার্ডের কিছু এলাকায় কম ওষুধ দেওয়া হতে পারে। তবে কোনো ওয়ার্ড বাদ থাকে না। সব ওয়ার্ডেই ওষুধ দেওয়া হয়।
মশার ওষুধ না ছিটানোর প্রসঙ্গে বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, বর্ধিত ওয়ার্ডগুলো মশার ওষুধ পায় না এ কথা ঠিক নয়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে শহরে মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়া কাউন্সিলরদের কাছে ওষুধ পাঠিয়েছি। তারা নিজ উদ্যোগে ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করছে।
সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সামির হোসেন মিশু বলেন, আমাদের আগে থেকেই সচতন হতে হবে। কারণ সংক্রামক ব্যাধি শুরু হওয়ার পর আমরা সচেতন না হলে ব্যাধিটি বাড়বে। ডেঙ্গু বগুড়াতেও দেখা দিয়েছে। ড্রেন বা বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননস্থল। এই জায়গাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এসব বিষয়ে পৌরসভাকে এগিয়ে আসতে হবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এফএ/এএসএম