বিদেশে বাড়ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৃতের সংখ্যা। প্রতিদিনই প্রবাসীদের মরদেহ আসছে বাংলাদেশে। মালয়েশিয়ায় গত এক মাসে ৭০ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।দূতাবাস সূত্র জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সে দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭০ জন বাংলাদেশি। মৃতদের মধ্যে একজন বাদে সবার মৃতদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে। এই ৭০ জনের মধ্যে বৈধ কর্মী ৩৬ জন, অবৈধ ২৩, ট্যুরিস্ট একজন, প্রফেশনাল ৩, স্টুডেন্ট একজন এবং অন্যান্য একজনসহ মোট ৭০ জন। এদের মধ্যে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ৬ জন।এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি হওয়ায় মূলত ওই অঞ্চল থেকেই মরদেহ যাচ্ছে সর্বাধিক। এর মধ্যে তালিকায় প্রথমে আছে সৌদি আরব। তালিকায় দুই নম্বরে মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে শুধু সৌদি আরব থেকেই ৪ হাজার ৩শ ৩ জনের মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। গত ১০ বছরে কেবল সরকারি হিসেবেই বিভিন্ন দেশে মারা গেছেন ২৪ হাজার ৩শ ৮১ জন। এই হিসেব কেবল বিমানবন্দর হয়ে যেসব মরদেহ বাংলাদেশে গেছে এবং দূতাবাস ও জনশক্তি রফতানি ব্যুরো (বিএমইটি) যেসব বাংলাদেশির মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে দাফতরিক সহায়তা দিয়েছে তাদের নিবন্ধিত হিসেব মাত্র। প্রকৃত হিসেব কত তা জানা যায়নি।এছাড়া যাদের মরদেহ ওইসব দেশেই দাফন করা হয়েছে তাদের বিষয়ে কোনো তালিকা বাংলাদেশের ওইসব দফতরে নেই বলে জানা গেছে। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। মানব পাচারকারীদের মিথ্যা প্ররোচনায় কত মানুষ সমুদ্র পথে কিংবা অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, তারপর আর হদিস মিলছে না সমুদ্রেই সলিল সমাধি হচ্ছে, এই রকম সংখ্যা তো একেবারে কম নয়। থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার গহীন জঙ্গলে শত শত গণকবরের হিসেব পাল্টে দিয়েছে সব হিসেব-নিকেশ।জানা যায়, সরকারি হিসেবে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন ২৪ হাজার ৩শ ৮১ জন। তবে ১০ বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বিদেশে প্রবাসী মৃত্যুর হার দ্বিগুণেরও বেশি।এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে প্রতি মাসে প্রবাসীর মরদেহ আসছে ১৯৭টি। তবে গত ৪ মাসের হিসেব আরো উদ্বেগজনক। প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের মরদেহ দেশে আসছে বলে জানা গেছে। এই হিসেবের বাইরে যাদের বিদেশে দাফন করা হচ্ছে তাদের সংখ্যা কত সে ধরনের কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট কারো কাছে পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি আছেন যারা সপরিবারে কয়েক যুগ ধরে বিদেশে আছেন। তাদের স্বজনরা ওই দেশেই দাফন করছেন।দৈত নাগরিকত্বের অধিকারীদের মৃত্যুর পর বিদেশেই দাফন করার হার বেশি। কিন্তু তাদের কোনো নিবন্ধন রাখছে না বাংলাদেশ দূতাবাস। তাই বিদেশে এ পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশিকে দাফন করা হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ওইসব দেশে কতজন বাংলাদেশিকে দাফন করা হয়েছে তার কোনো হিসেব তারা দিতে পারেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও এইসব তথ্য রাখার মতো কোনো আলাদা ডেস্ক নেই বলে জানা গেছে।বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রতি বছরই প্রবাসে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের হিসেবে ২০০৫ সালে বিদেশে মারা গেছেন ১ হাজার ২৪৮ জন। ২০০৬ সালে এর সংখ্যা আরো ২শ জন বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০২ জন। তারপর ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩ জন, ২০০৮ সালে ২ হাজার ০৯৮ জন, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০ জন।গত চার বছরে প্রবাসে মৃত্যুর সংখ্যা আগের হিসেবের দ্বিগুণ। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে বিদেশে মারা গেছেন ১১ হাজার ৮শ ৭৪ জন। এর মধ্যে ২০১১ সালে মারা গেছে ২ হাজার ৫৮৫ জন। ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬ জন এবং ২০১৪ সালে মারা গেছে ৩ হাজার ৩৩৫ জন। আর চলতি বছর এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২১১ জনের মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।পরিসংখ্যানে জানা যায়, স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, আত্মহত্যা এমনকি প্রবাসে বাংলাদেশিরা খুনের ঘটনারও শিকার হচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধে ৪৭টি দেশে ৭৮ জন বাংলাদেশিকে ওইসব দেশের আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মানবিক কারণে ২৯ জনের মৃত্যুদণ্ড রহিত করে তাদের অন্য দণ্ড দিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।জানা যায়, প্রবাসে বাংলাদেশি মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে আছে সৌদি আরব। এরপরের অবস্থানে মালয়েশিয়া। তবে থাইল্যান্ড সীমান্তে মানব পাচারকারীদের হাতে নিহত বাংলাদেশিদের সঠিক হিসেব এবং শত শত গণকবরে বাংলাদেশিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে উক্ত তালিকায় এক নম্বরে চলে যেতে পারে মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড।গত কয়েক বছরে বিদেশ থেকে যত মরদেহ এসেছে তার প্রায় ৬৫ ভাগ এসেছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত থেকে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে শুধু সৌদি আরব থেকেই বাংলাদেশে প্রবাসীদের মরদেহ পাঠানো হয়েছে ৪ হাজার ৩০৩ জনের।প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ বহন করে থাকে। ওই বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৯৩ সাল থেকে সর্বমোট ২১ হাজার ২২৯ জনের মরদেহ দেশে আনা বাবদ ৫৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।এছাড়া ৯ হাজার ৭শ ৫৪ জন শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ বাবদ ওই বোর্ডের তহবিল থেকে অনুদান পেয়েছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক ধীরগতি, হয়রানিসহ নানা কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।বিএ
Advertisement