দেশজুড়ে

১৩০ বছরেও স্বাদ-ঘ্রাণে অপরিবর্তিত বি সাহার মিষ্টি

মিষ্টি ছোট-বড় সকলেরই পছন্দের খাবার। এর নাম শুনতেই জিভে জল আসে সবার। আর সেই মিষ্টি যদি হয় ১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী, তাহলেতো কথাই নেই। ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির স্বাদ নিতেই দূর-দূরান্ত থেকে এখনো মানুষজন ছুটে আসে। বলছি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের বি সাহার মিষ্টির কথা। এটি হরেক রকম মিষ্টি আর দধি তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রসিদ্ধ।

Advertisement

বি সাহার মিষ্টির দোকানটি রামগঞ্জ পৌরসভার সোনাপুর বাজারে অবস্থিত। প্রায় ১৩০ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন স্থানীয় জগবন্ধু সাহা। পরবর্তীতে ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে বিশ্বেশ্বর সাহা। তার নামেই প্রতিষ্ঠানটি যুগ যুগ ধরে অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছে। যার স্বাদ আর ঘ্রাণ এখনো পরিবর্তন হয়নি। জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বি সাহা সুইটস। রামগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে সোনাপুর সিঅ্যান্ডবি কার্যালয় ঘেঁষে পশ্চিমে সোজা রাস্তার কিছুদূর যেতেই বাজারের মধ্যখানে ছোট ব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণ পাশে দেখা মিলবে স্বাদের সেই মিষ্টির দোকান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর সাজানো-গোছানো দোকানটি অবশ্যই সবার নজর কাড়বে।

প্রথমেই নজর পড়বে দোকানের সামনে সাঁটানো হরেক রকম মিষ্টির নামের ফেস্টুনে। অনেকেই এর সঙ্গে পরিচিত নয়। আবার অনেকেই এসব মিষ্টি বছরের পর বছর খেয়ে আসছেন, তবে নাম জানা নেই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য রসগোল্লা, রস মালাই, ল্যাংচা, ক্ষির চমচম, মালাইকারী, কাঁচা সন্দেশ ও কালোজাম।

এছাড়া এখানকার ক্ষিরদধি ও টক-মিষ্টি দধিও বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন উৎসবের জন্য ভিন্ন ধরনের এক মিষ্টান্ন এখানে পাওয়া যায়। এর নাম ছানার পোলাও। আলমারিতে সাজানো মিষ্টিগুলোও বেশ লোভনীয়। এছাড়া দোকানের ভেতরে কয়েকটি ফ্রিজে সংরক্ষিত মাটির পাত্রের দইও সমানতালে সুস্বাদু।

Advertisement

এই দোকানে মিষ্টি খেতে গেলে ভিন্ন ধরনের এক পরিবেশনা চোখে পড়ে, যা জেলার আর কোথাও দেখা যায় না। স্টিলের বাটিতে মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। এর সঙ্গে দেওয়া হয় তরল দুধ। এছাড়া ক্ষির, দধি বড় ও ছোট মাটির পাত্রে বসানো হয়। ক্ষিরদই, মিষ্টিও মোলায়েম। জিভের সঙ্গে মিশে যায় মালাইকারী ও লেংচা।

বি সাহা সুইটস কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৮৯০ থেকে ৯৫ সালের কোনো এক সময় জগবন্ধু সাহা নামের এক কিশোর জিলাপি তৈরি শুরু করেন। তখন তার বয়স ষোল কিংবা আঠারো ছিল। তার হাতে জাদুর ছোঁয়া ছিল। রসে টইটম্বর জিলাপিতে রসগোল্লার মতো স্বাদ ছিল। প্রতি রোব ও বৃহস্পতিবার সোনাপুর বাজারে তাকে জিলাপি বিক্রি করতে দেখা যেতো। চাহিদা কম থাকলেও কখনোই এটি উদ্বৃত্ত থাকতো না।

সোনাপুর বাজারের অদূরে হরিসভা এলাকায় তার নিবাস ছিল। সোনাপুর বাজারে তৈরি করা জিলাপি আশপাশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর তিনি বিভিন্ন বাজারে গিয়ে সাপ্তাহিক হাটের দিন জিলাপি বিক্রি করতেন। এভাবেই জগবন্ধু সাহার তৈরি জিলাপির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই সোনাপুর বাজারেই তিনি দোকান নির্মাণ করেন। প্রায় ৪০ বছর তিনি মিষ্টির ব্যবসা করেন।

১৯৫৩ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বিশ্বেশ্বর সাহা মিষ্টির ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাবার স্মৃতি ঘেরা ব্যবসাটিকে প্রাণবন্ত করতে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে জানান দেওয়া শুরু করেন বিশ্বেশ্বর সাহা ওরফে বি সাহা। সেই দোকানটিই এখনো বি সাহা সুইটস হিসেবে সুনাম ছড়াচ্ছে।

Advertisement

জানা গেছে, বি সাহা নিজেই মিষ্টি তৈরি করতেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি সবসময় পবিত্র থাকতেন। তার ভাষ্য ছিল, ‘তৈরি করা মিষ্টি মুসলমানদের মিলাদ মাহফিল, হিন্দুদের পূজা উৎসবসহ পবিত্র কাজে পরিবেশন করা হবে। তাই সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মিষ্টি তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে বিক্রির সময়ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তৈরি করা মিষ্টি অবশ্যই আগে নিজেরা খেয়ে দেখতে হবে। কারণ যে খাবার নিজের কাছে ভালো লাগবে না, তা অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে না।’

বর্তমানে বি সাহার ছেলে অপূর্ব কুমার সাহা অপু ও সমীর রঞ্জন সাহা দোকানটি পরিচালনা করে আসছেন। বি সাহার ছোট ছেলে সমীর রঞ্জন সাহার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট ছোট খামারিরা প্রতিদিন গরুর দুধ দিয়ে আসেন দোকানে। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যেই দুধ সংগ্রহ শেষ হয়। এরমধ্যে মিষ্টির জন্য দুধ প্রস্তুতকরণ শুরু হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০০ কেজি দুধ সংগ্রহ করেন তারা। এক সময় যখন মিষ্টির প্রচুর চাহিদা ছিল তখন প্রায় ৫০০ লিটার দুধ সংগ্রহ করতে হতো। তবে বি সাহার মিষ্টির সুনাম এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে।

বি সাহার বড় ছেলে অপূর্ব কুমার সাহা অপু বলেন, দাদুর হাত ধরেই এ ব্যবসার শুরু। ১৯৯২ সালে বি সাহা সুইটসের নামকরণ করা হয়। আমার বাবা রামগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন। সবাই তাকে বি সাহা নামে ডাকতেন। এজন্য দোকানের নামও বি সাহা সুইটস দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন আমার দাদু জগবন্ধু সাহা।

তিনি আরও বলেন, ২৫ বছর আগেও গরুকে ঘাস খাওয়ানো হতো। তখন দুধের মান ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। এখন গরুকে খাওয়ানো হয় ফিডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক খাবার। এখন গরুর দুধ পাতলা হয়। এজন্য মিষ্টান্নতে আগের চেয়ে কিছুটা স্বাদ কমে গেছে।

জানতে চাইলে রামগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুল হাসান ফয়সাল মাল বলেন, বি সাহা সুইটসে মিষ্টির জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এখনো মানুষ ছুটে আসে। রামগঞ্জের যারা ঢাকা-চট্টগ্রামে থাকেন তারাও এখান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। এলাকায় এলে একবার হলেও মিষ্টি খাওয়ার জন্য এখানে ছুটে আসেন।

এফএ/এএসএম