দেশজুড়ে

সরকারি গুদামে কৃষকদের বদলে ধান দিচ্ছেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

বগুড়ার শেরপুরে অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ অভিযানে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার সরকারি নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না। তাই সরকারি গুদামে কৃষকদের বদলে ধান দিচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। ফলে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা সরকারের দেওয়া সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

Advertisement

তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্তাদের দাবি, প্রকৃত কৃষকদের নিকট থেকেই ধান কেনা হচ্ছে। এজন্য লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকেই ধান সংগ্রহ চলছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। ধান ক্রয়ের নিয়ম ডিজিটালাইজড করা হলেও সেখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকদের সিংহভাগই ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের স্বজন অথবা নিজস্ব লোক। এমনকি অনেকের জমিও নেই। খাদ্য বিভাগের কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাগজ-কলমের মারম্যাচে ধান সংগ্রহের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় এক হাজার ৫৬৮ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে মোতাবেক বিগত ২৫ মে ধান সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয়। আগস্টের ২৮ তারিখ পর্যন্ত ধান সংগ্রহ চলবে।

বুধবার (১২ জুলাই) পর্যন্ত এ উপজেলার দুটি সরকারি খাদ্য গুদামে ৯৭৬ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ দেখিয়েছে খাদ্য বিভাগ। এরমধ্যে শেরপুর ধুনটমোড় খাদ্য গুদামে ধান কেনা হয়েছে ৪৮৬ মেট্রিকটন এবং মির্জাপুর খাদ্য গুদামে ৪৯০ মেট্রিকটন। যা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ওইসব ধান ক্রয় করা হয়নি।

Advertisement

আরও পড়ুন: চাল সংগ্রহে অনিয়মের অভিযোগ

শুধুমাত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের স্বজন ও নিজস্ব কৃষকদের নিকট থেকে ওইসব ধান কেনা দেখিয়ে তাদের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে ওই সিন্ডিকেট চক্র পকেট ভরেছে। তাই ধান সংগ্রহের উদ্বোধন ও লটারির কোনো তথ্যই জানানো হয়নি স্থানীয় কৃষকদের।

উপজেলার বরেন্দখ্যাত মির্জাপুর, বিশালপুর, ভবানীপুর ও শাহবন্দেগী ইউনিয়নের বেশির ভাগ কৃষক এমনটি জানিয়েছেন। সোহেল হাজী, মতিউর রহমান, গোলাম রব্বানীসহ একাধিক কৃষক জানান, এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে তাদের উৎপাদিত ধানের কাঙ্খিত দাম পাননি। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাকিতে কৃষি উপকরণ কিনে চাষাবাদ করেছি। তাই ধান-কাটা মাড়াইয়ের পর কমদাম হলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই সেটি বিক্রি করে দিয়েছি।

তারা জানান, আমরতো জানিই না কবে সরকারি গুদামে ধান কেনা হবে। তাই সেখানে বিক্রি করবো কীভাবে। আমরা ধান বিক্রি করতে গেলে নিয়মের শেষ নেই। দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এছাড়া সরকারি গুদামে একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে। সব মহলকে ম্যানেজ করে কৃষকদের বদলে তারাই ধান দেন। এক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষের কৃষি কার্ড ভাড়া নেওয়া হয়। নামমাত্র টাকা দিয়ে তাদের নামেই সরকারি গুদামে ধান বিক্রি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা লোপাট করা হচ্ছে।

Advertisement

সরেজমিনে শহরের ধুনটমোড়স্থ খাদ্য গুদামে গিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে কোনো কৃষককে দেখা না গেলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের দেখা মেলে। এমনকি ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রমও গতিহীন। গুদামে একটি চালবোঝাই ট্রাক আনলোডের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া সবই ফাঁকা। ধান-চাল বোঝাই কোনো যানবাহনও নেই। তবে কাগজ-কলমে ধান সংগ্রহে ব্যস্ত গুদামের কর্মকর্তারা। একই চিত্র উপজেলার মির্জাপুর খাদ্য গুদামে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট অফিসের এক কর্মচারী বলেন, আপনারা (সাংবাদিকরা) সব কিছুইতো বুঝেন। এখনতো আর কৃষকরা ধান বিক্রি করে না। তবে তাদের নিকট থেকেই ধান কেনা দেখিয়ে মিলারদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। আর এসব কেবল কলমের মারপ্যাচেই হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: আশুগঞ্জে সরকারি চাল সংগ্রহের নামে বাণিজ্য

ধান সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে ধুনটমোড় খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে মন্তব্য করার আগে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক স্যারের কথা বলে আপনাকে জানাবো। এ মুহূর্তে কিছুই বলতে পারবো না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার বলেন, সরকারিভাবে বোরো ধান বিক্রির জন্য যেসব কৃষক আবেদন করেছেন তাদের তালিকা আমরা খাদ্য বিভাগের কাছে সরবরাহ করেছি। অকৃষক তালিকাভুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মামুন-এ কাইয়ুম বলেন, ধান কেনার জন্য প্রথমেই লটারির মাধ্যমে আমরা কৃষক নির্বাচন করেছি। তাদের নিকট থেকেই ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখানে অনিয়মের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কোনো অনিয়ম হলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরএইচ/জেআইএম