প্রবাস

নানা ঘটনার সাক্ষী মিশরের আল আজহার মসজিদ

মিনারের শহর কায়রোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদ আল-আজহার। নানা ঘটনার সাক্ষী এই মসজিদকে কেন্দ্র করে একই নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। ৯৭২ সালের ২৩ জুন এই মসজিদে প্রথম জুমা শুরু হয়।

Advertisement

মসজিদটি ফাতেমীয় খলিফা আল মুইজ লিদিনাল্লাহ ৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল নির্মাণ শুরু করেন। প্রথমে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়টি আল-আজহার মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম।

মুসলিম বিশ্বের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র মসজিদটি প্রতিষ্ঠার পর, ৯৮৯ সালে স্থানীয়দের কোরআন-হাদিস ও ইসলাম বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ৩৫ জন আলেম নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে মসজিদটি ধীরে ধীরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মুসলিম বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ শরিয়া বিষয়ক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

আল-আজহারে অধ্যায়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

Advertisement

প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীরা কোরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষা নেন। পরবর্তীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ফার্মেসি, মেডিসিন, প্রকৌশল, কৃষি, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৬১ সালে জাতীয়করণ করা হয় এবং স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আফ্রিকা মহাদেশের আজকের বৃহত্তম শহর কায়রো প্রতিষ্ঠা করেন সিসিলি থেকে আগত জওহর-আল-সিকিলি নামের গ্রিক বংশোদ্ভূত ফাতেমীয় এক সেনাপতি। তিনি ফাতেমীয় খিলাফতের পূর্ববর্তী রাজধানীর নামানুসারে এর নাম দিয়েছিলেন ‘আল মানসুরিয়া। তখনকার সাধারণ রীতি হিসেবে মসজিদটিকে ‘জামে আল মানসুরিয়া’ তথা ‘মানসুরিয়ার মসজিদ’ বলা হতো। খলিফা আল মুইজ লিদিনাল্লাহ শহরের নাম বদলে আল কাহিরা রাখেন। এরপর মসজিদের নাম ‘জামে আল কাহেরা’ তথা ‘কায়রোর মসজিদ’ বলা হতো।

মসজিদের বর্তমান নামটি খলিফা আল মুইজ থেকে মিশরের দ্বিতীয় ফাতেমীয় খলিফা আল আজিজ বিল্লাহর সময়কার। আজহার শব্দটি আরবি আজ জাহরা শব্দ থেকে এসেছে। ‘আজ জাহরা’ অর্থ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। হজরত মুহাম্মদ (সা).-এর কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর উপাধি ছিল এটি। এই উপাধির সঙ্গে মিল রেখে, তাকে উদ্দেশ্য করেই মসজিদটির নাম দেওয়া হয় ‘আল আজহার মসজিদ।’

এক হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে আল-আজহার মসজিদ কখনো উপেক্ষিত হয়েছে, আবার কখনো গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আল আজহারের আলেমদের ওপর সরকারি নানাবিধ বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে। কেউ তা মেনেছেন, অনেকে আবার বিদ্রোহ করে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। শুরুতে এখানে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। ১০০৫ খ্রিস্টাব্দের পর সেখানে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। মসজিদের নিজস্ব ছাপাখানা চালু করা হয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।

Advertisement

১৯৫২ সালে মুহাম্মদ নজিব ও জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের বিপ্লবের পর মিশরের রাজতন্ত্র উৎখাত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদ পৃথক করা হয়। ১৯৫৫ সালে আধুনিক ক্যাম্পাসের জন্য মসজিদের চারপাশের স্থান অধিগ্রহণ করে পুরোনো স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ১৯৬১ সালের আইনে আল আজহারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পৃথক করা হয়। এই আইনে আল আজহারে ধর্ম-বহির্ভূত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মিশরের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জামাল আবদেল নাসের আল আজহারে বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেন।

পৃথিবীর বহু শাসক ও সুলতান এখানে পড়াশোনা করেছেন। এমনকি, অনেক দেশের রাষ্ট্রপতি, গ্র্যান্ড মুফতী, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এখানের ছাত্র ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসক, মিশর ভ্রমণে আল-আজহার দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। গত এক হাজার বছরে আরব বিশ্বের যত স্কলারলা জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা কোনো না কোনো দিক থেকে আজহারের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেছেন।

ইবনে হাজার আসকালানি, ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ুতি, ইমাম বদরুদ্দীন আইনি, ইমাম কুস্তলানি, ইমাম দাকিক ইবনে ঈদ, ইমাম ত্বহাবীর মতো সহস্র জগৎবিখ্যাত মনীষীদের সৃষ্টি করেছে এই আজহার। এই তালিকা এতই ব্যাপক যে যার ওপর অসংখ্য গ্রন্থ ও রচিত হয়েছে।

আল আজহার সম্পূর্ণ সুফীজমে বিশ্বাসী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে চার মাজহাবের সমন্বয়ে, একাডেমিক সিলেবাস প্রণয়ন হয়ে থাকে। ছাত্ররা চার মাজহাবের যে কোনোটি নিয়ে এখানে পড়তে পারে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন যুগে এই মসজিদটির পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। মামলুক সালতানাতের সময়, সুলতান আশরাফ কায়েদ বাই এবং মামলুক শেষ সুলতান কানসুয়াহ আল গাওরীর শাসনামলে, মাসজিদের মিনার নির্মাণ ও অভাবনীয় সংস্কার হয়। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী (রহ:) মিশরে প্রবেশের সময়, আজহার ছাড়া অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। তিনি আল-আজহারের আদলে, প্রায় ২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। মুসলিম বিশ্বের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে, গণ্য হয় আল-আজহার।

বর্তমানে আল-আজহারের প্রধান গ্র্যান্ড ইমাম শাইখুল আজহার ড. আহমাদ আত তাইয়্যেব হাফিজাহুল্লাহ। যিনি আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লাখ ছাত্র-ছাত্রী ও ৫০ হাজার শিক্ষকের অভিভাবক। আজহারের সমস্ত কিছুই তার স্বয়ত্তশাসনে নিয়ন্ত্রণাধীন।

বিশ্বের ১১৭টি দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বর্তমানে ছয় শতেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আল-আজহারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পড়াশোনা করছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০টি ফুল স্কলারশিপের মাধ্যমে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখানে সাফল্যের সাথে পড়াশোনা করছে। এমনকি প্রতিটি বর্ষে আমাদের ছাত্ররা ফলাফলে প্রথম, দ্বিতীয়সহ প্রথম দশজনের মাঝে স্থান করে নেয়।

এমআরএম/জেআইএম