আগে প্রাত্যহিক নানা কাজে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। মৃৎশিল্প মাদারীপুর জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। অথচ এই শিল্প আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।
Advertisement
একসময় বহু পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও দিনদিন কমে যাচ্ছে সংখ্যা। আর যারা কাজ করছেন তারাও নানা প্রতিকূলতার মাঝে কোনোরকমে টিকে আছেন। তাদের দাবি, সরকারিভাবে এই শিল্পে সহযোগিতা ও আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে পারলে আবার ফিরবে এর হারানো জৌলুস।
আরও পড়ুন: হুমকির মুখে ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মাদারীপুরে কুমার সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫৫ পরিবারের ৭৭৫ নারী-পুরুষ মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে কোনোমতে টিকে আছেন। এরমধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৪৩টি পরিবার, রাজৈর উপজেলায় ৫৮টি পরিবার, শিবচরে ২৮টি পরিবার এবং কালকিনিতে ২৬টি পরিবার আছে।
Advertisement
সদর উপজেলার চরমুগিয়ার পিটিআই রোড এলাকা, পূর্ব রাস্তি, কুলপদ্দী, ঘটমাঝি, মস্তফাপুর, রাজৈর উপজেলার খালিয়া, গোয়ালবাথান, সেনদিয়া, কদমবাড়ি, মজুমদারকান্দি, শিবচর উপজেলার চান্দেরচর, দ্বিতীয়াখণ্ড, দত্তপাড়া, পাচ্চর, কালকিনি উপজেলার বাঁশগাড়ির খাসেরহাট, পালপাড়ায় কুমাররা আছেন।
জেলার মৃৎশিল্পীরা মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির পাশাপাশি সব ধরনের দেবদেবীর প্রতিমা তৈরিতে দক্ষ। এছাড়া হাড়ি, কলস, মটকা, বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক, ফুলদানি, সানকি, বদনা, দইয়ের ভাঁড়, ঘটি, মালসা, পাতিল, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করে থাকেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর জেলা মৃৎশিল্পের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে সিলভার, স্টিল, প্লাস্টিক, সিরামিক, চীনামাটির অত্যাধুনিক তৈজসপত্রের কারণে মৃৎশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়া, মাটির দাম বেশি, জ্বালানির দাম বেশি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব, মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য আলাদা ঘরের অভাবসহ নানা কারণে মৃৎশিল্পদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে। ফলে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। আর যারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তারা ঠিকমতো সংসার চালাতেই পারছেন না।
তবে কুমারদের দাবি, বর্তমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে মাটির সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করতে পারলে তাদের সচ্ছলতা আসবে। আর এই সৌখিন জিনিসপত্র তৈরির জন্য তাদের বিভিন্ন উপকরণসহ প্রশিক্ষণ দরকার। মাদারীপুরে তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দিনদিন হারাতে বসেছে এই পেশা। আর নানা প্রতিকূলতার মাঝেও যারা এই পেশায় আছেন, তারা মূলত পৈত্রিক এ পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন।
Advertisement
আরও পড়ুন: প্লাস্টিক-সিলভারের ভিড়ে হুমকির মুখে মৃৎশিল্প
মাদারীপুরের চরমুগরিয়ার কুমারপাড়ার কুমাররা জানান, বর্তমানে বেশিরভাগ কুমারের পুনের ঘর (যে ঘরে চুলার মধ্যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানো হয়) নেই। তাই তাদের জিনিসপত্র পোড়াতে সমস্যা হয়। তাছাড়া যাদের পুনের ঘর আছে, তাও জরাজীর্ণ। বর্ষার সময় বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া মাটির দাম বেশি, জ্বালানির দাম বেশি হওয়ায় তারা জিনিসপত্র বানাতে পারছেন না। তাছাড়া তারা সেই পুরোনো জিনিসপত্রই বানান। কিন্তু আধুনিক জিনিসপত্র বানানোর বিষয়ে সরকারিভাবে যদি তাদের সহযোগিতা বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হলে এই শিল্পের দুর্দিন যেত।
সদর উপজেলার চরমুগরিয়ার কুমারপাড়ার দুলাল পাল বলেন, এ পেশায় থেকে জীবন আর চলে না। আগের মতো মানুষজনের কাছে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। যা আয় হয় তা দিয়ে ঠিকমতো খেতেই পারি না। তাই ভাবছি অটোরিকশা চালাবো। তাতে করে আমাদের সংসার চলবে। কষ্ট কম হবে। কিছুটা হলেও অভাব দুর হবে।
একই এলাকার সুবাস পাল বলেন, অনেকদিন ধরে ভাবছি এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাবো। কিন্তু বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে মন চায় না। অনেক কষ্ট করে এখন পর্যন্ত টিকে আছি। কতদিন পারবো জানি না।
একই উপজেলার খোয়াজপুর এলাকার অনিমেষ পাল বলেন, আমার বাবা সুকুমার পাল এখনও এ কাজ করছেন। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের ভিড়ে আমাদের এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এ পেশায় থেকে পেটের খাবারটুকুই যোগাড় করা কষ্টকর। তাই বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে ব্যবসা করছি।
কালকিনি উপজেলার পালপাড়া এলাকার সুশান্ত পাল বলেন, এখানকার সিতীশ পাল, নারায়ণ পাল, কমল পাল, বিবেক পাল, খগেন পাল, গণেশ পাল, সুশীল পাল, নিখিল পাল, বাদল পাল, শ্যামল পাল, অমল পাল, বিকাশ পালসহ প্রায় ৩০ জন এ পেশা ছেড়েছেন। তারা দিনমজুরি, চায়ের দোকান, অটোরিকশা চালানোসহ নানা কাজ করছেন। আমি নিজেও অনেক আগে এ পেশা ছেড়ে চা এর দোকান দিয়েছি।
মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষণ সাংবাদিক সুবল বিশ্বাস বলেন, এক সময় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ জেলার শত শত মানুষ। এরা কুম্ভকার বা কুমার নামে পরিচিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের এক শ্রেণির লোক এদের অন্তর্গত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাল বংশের কিছু লোক এ পেশায় নিয়োজিত। কাদামাটি দিয়ে কুমাররা বিভিন্ন আকৃতির হাড়ি-পাতিল-বাসন-কোসনসহ গৃহস্থালির কাজের উপযোগী নানা সামগ্রী তৈরি করে থাকেন।
তিনি বলেন, হাত এবং চাকার সাহায্যে কাদা মাটি দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরির পর কাঁচা থাকতে তাতে কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও রেখাদির নকশা করা হয়। কখনো আবার দ্রব্যাদি পোড়ানোর পর এতে নানা রঙের সমাবেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ আকর্ষণীয় নকশা করা হয়। খেলার পুতুল ও ঘর সাজানোর সৌখিন দ্রব্যও কুমাররা তৈরি করেন। তারা হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করেন। বাঁশ, খড়কুটা, মাটি, কাপড় ও রং দিয়ে নির্মিত তাদের এ মূর্তিগুলো এক অসাধারণ শিল্পকর্ম।
সাংবাদিক সুবল আরও বলেন, কুমার শ্রেণির মেয়েরা মৃৎশিল্পের নানা দ্রব্য তৈরিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করেন। এতে রয়েছে তাদের সুনিপুণ দক্ষতা এবং কুশলতা। তবে বর্তমানে এ শিল্পের দুর্দিন চলছে। একে বাঁচাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। তা না হলে এক সময় এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: মৃতপ্রায় নরসিংদীর মৃৎশিল্প
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া তাদের জন্য একটি শোরুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। সেখানে তারা তাদের উপকরণ রেখে বিক্রি করতে পারবে। এতে করে কুমাররা উপকৃত হবে।
এমআরআর/আরএইচ/জেআইএম/