বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে দুর্বল ও চরম ঝুঁকির নাম ‘সিগন্যাল ব্যবস্থা’। ৮০ শতাংশ সিগন্যাল পয়েন্টের আয়ুকাল প্রায় অর্ধশত বছর আগেই শেষ হয়েছে। ফলে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল রেলের ২৫৫টির মধ্যে ৬৬ স্টেশন ও স্টেশন সেকশনে কোনো ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ৩১ স্টেশনে আধুনিক সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থা থাকলেও ১৫৮টি স্টেশন ব্রিটিশ আমলের পুরোনো পদ্ধতির ম্যানুয়াল বা হ্যান্ডেল সিগন্যালে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে গতি পাচ্ছে না এ অঞ্চলে চলাচল করা রেল।
Advertisement
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমাঞ্চলের ১৬৮৪ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন ২৫৫টি। পশ্চিমাঞ্চল রেলপথে আন্তঃদেশীয় মৈত্রী ও মিতালী এক্সপ্রেস বাদে ৫২টি আন্তঃনগর, ছয়টি লোকাল ও ৩১টি মেইল ট্রেন চলাচল করে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত চলাচল করে মালবাহী ট্রেনও। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ রেলপথের ৮০ শতাংশ স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়নি। পশ্চিমাঞ্চল রেলে মাত্র ৩১টি স্টেশন আধুনিক সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং প্রতিস্থাপন হয়েছে।
সম্প্রতি ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর সেকশনের স্টেশনগুলোর সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন এবং আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৭ মেয়াদে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে আরও ২০টি স্টেশন আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার আওতায় আসবে।
‘প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি করে নতুন ট্রেন চালু করছে রেলওয়ে। একইসঙ্গে বাড়ছে নতুন রেলপথ। কিন্তু সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে রেলের যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল রেল তা দেয়নি’
Advertisement
আরও পড়ুন: মেয়াদ শেষ হলেও শুরুই হয়নি কাজ, প্রকল্পের ধীরগতিতে বাড়ছে জটিলতা
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু আছে। এরমধ্যে সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাটি হচ্ছে রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। এ ব্যবস্থাটি পুরোপুরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত যেসব স্টেশনে বেশি ট্রেন চলাচল করে সেসব স্টেশনে এ ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া সিবিআই (কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং) সিগন্যাল, সিটিসি (সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল), পুরোনো আমলের মেকানিক্যাল ইন্টারলকড সিগন্যাল ব্যবস্থা। এ রকম সিগন্যালের জন্য লাইনের পাশে এক ধরনের তার ব্যবহার করা হয়, যা সংযুক্ত থাকে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত লিভারের সঙ্গে। এ লিভারে টান দিয়ে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার লাল-সবুজ বাতি ব্যবহার করে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ সিগন্যাল যে স্টেশনে ব্যবহার হয় সে স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগে স্টেশনমাস্টার লোকজন দিয়ে সিগন্যাল ঠিক করেন কোন লাইন দিয়ে ট্রেন যাবে।
রেল বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রেন চলাচলে নিরাপত্তা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা, ট্রেন চলাচলের গতি বৃদ্ধি, সেকশনের ট্রেন চলাচলের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, অপারেশনাল সুবিধা বৃদ্ধি ও ট্রেনের ভ্রমণ সময় কমানোসহ রেলসেবা বৃদ্ধির জন্য রেলে সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি করে নতুন ট্রেন চালু করছে রেলওয়ে। একইসঙ্গে বাড়ছে নতুন রেলপথ। কিন্তু সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে রেলের যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল রেল তা দেয়নি। সিগন্যালিং আধুনিকায়নের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সিগন্যালের আধুনিকায়ন কাঙ্ক্ষিতভাবে হয়নি। ট্রেনের সংখ্যা ও লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না।
তারা বলছেন, সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম লোকবল। আর যে লোকবল রয়েছে তা অধিকাংশ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগকৃত এবং অদক্ষ। প্রতিবছর রেলে যে দুর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৯০ ভাগ সিগন্যাল ব্যবস্থার ক্রুটির কারণে ঘটছে।
Advertisement
‘পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৩১টি স্টেশনে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে। আর অন্যসব রেল স্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থার আয়ুকাল অর্ধশতাব্দী আগে শেষ হয়েছে’ আহমেদ ইশতিয়াক জহুর, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী এবং বিভাগীয় সংকেত প্রকৌশলী রাজশাহী সদর
ঈশ্বরদীর ঊধ্বর্তন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সংকেত) কার্যালয়ের সিগন্যাল মেইনট্রেনার (এমএস) সাগর আলী জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে ২০২২ সালে রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং পদ্ধতি চালু হয়। এটি সর্বাধুনিক ও পুরোপুরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। ঈশ্বরদী দেশের বৃহৎ রেল ইয়ার্ড। আগে মাসে অন্তত ১৫ দিন সান্টিং ট্রেন এ ইয়ার্ডে লাইনচ্যুত হতো। ফলে রেলকর্মীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হতো। পাশাপাশি ট্রেন আউটার সিগন্যালে আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতো। স্টেশনমাস্টার সিগন্যাল দিলে তবেই ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করতো। সিগন্যাল আধুনিকায়নের ফলে আগে ট্রেন ৬০ কিলোমিটারের বেশি বেগে (স্পিড) যেতে পারতো না এখন ১১০ কিলোমিটার দ্রুতবেগে ট্রেন চলাচল করতে পারে। এছাড়া আগে একটি ট্রেন ক্রসিং করতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগতো এখন আধুনিকতার ফলে দুই মিনিটের মধ্যে তা সম্ভব।
আরও পড়ুন: চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ৬২ শতাংশ কাজ শেষ
ঈশ্বরদীর মতো দেশের প্রতিটি স্টেশনের সিগন্যাল আধুনিকায়ন হলে ট্রেন দুর্ঘটনা একেবারে কমে যাবে। পাশাপাশি রেলের সেবার মান আরও উন্নত হবে বলে জানান তিনি। ঈশ্বরদী রেলওয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক) জাহিদুল আলম সনো বলেন, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের প্রায় এক কিলোমিটার আগে আউটার সিগন্যাল থাকে। সে সিগন্যালে সবুজ ও হলুদ সংকেত থাকলে ট্রেন স্টেশনের পথে অগ্রসর হয়। এরপর স্টেশনে প্রবেশের ২০০ মিটারের মধ্যে হোম সিগন্যাল থাকে সেখানে সবুজ সংকেত থাকলে ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করে। যদি আউটার সিগন্যালে লাল সংকেত থাকে তাহলে ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। সবুজ সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ট্রেন স্টেশনের পথে অগ্রসর হতে পারে না। ট্রেন স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় স্ট্যাটার সিগন্যালের সংকেত দেখে ছাড়তে হয়।
তিনি বলেন, রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা সব স্টেশনে আধুনিক না হওয়ায় আউটার সিগন্যালে ট্রেন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন ক্রসিং করার সময়ও বিলম্ব হয়। এছাড়া ট্রেন দ্রুতগতিতে চালানো সম্ভব হয় না। ট্রেনের আধুনিক ও ম্যানুয়াল সিগন্যালের পাশাপাশি আরও কিছু সিগন্যাল রয়েছে যেগুলো ট্রেন চালকদের মেনে চলতে হয়। যেমন ট্রেনের লাল-সবুজ পতাকা সিগন্যাল, লাল ব্যানার সিগন্যাল, ফক (আওয়াজ) সিগন্যালসহ আরও অনেক সিগন্যাল রয়েছে। ট্রেনের সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিক হলে ট্রেন দুর্ঘটনা কমবে এবং ট্রেনের গতি বাড়বে।
‘প্রতিবছর রেলে যে দুর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৯০ ভাগ সিগন্যাল ব্যবস্থার ক্রুটির কারণে’
পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী এম এম রাজিব বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর, পাকশী থেকে দর্শনা, ঈশ্বরদী থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইনের বেশ কিছু স্টেশনে সিগন্যালের আধুনিকায়ন হয়েছে। আব্দুলপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আব্দুলপুর থেকে চিলাহাটি, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড় রুটের স্টেশনগুলোর বেশিরভাগ সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হয়নি। এছাড়া পোড়াদহ থেকে রাজবাড়ী, ভাঙ্গা, কালুখালী ও কাশিয়ানি রুট পুরোনো সিগন্যাল পদ্ধতিতে চলছে। সম্প্রতি ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আব্দুলপুর-পার্বতীপুর সেকশনের স্টেশনগুলোর সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন এবং আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৭ মেয়াদে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে।
আরও পড়ুন: ৫ বছর পর চালু হলেও ভরসা অবসরে যাওয়া কর্মীরা
বিভাগীয় সংকেত প্রকৌশলী রাজশাহী সদর এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী আহমেদ ইশতিয়াক জহুর জাগো নিউজকে বলেন, ট্রেনকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা ও দ্রুতগতিতে চলাচলের জন্য আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা জরুরি। পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৩১টি স্টেশনে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যসব রেলস্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থার আয়ুষ্কাল অর্ধশতাব্দী আগে শেষ হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালাতে হচ্ছে। রেলের নিরাপত্তা ও গতি নিশ্চিত করতে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার ওপর রেলওয়েকে গুরুত্ব দিতে হবে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রবিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, রেলের অধিকাংশ স্টেশনে ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। এখনো কিছু কিছু স্টেশনে বাঁশের মই ব্যবহার করে নির্ধারিত পিলারে লাল-সবুজ বাতি লাগিয়ে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরকম মান্ধাতার আমলের সিগন্যাল ব্যবস্থায় চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। ফলে মাঝে মধ্যেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। সুশৃঙ্খল ও ঝুঁকিমুক্ত ট্রেন চলাচলের জন্য আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা খুবই জরুরি। রেল সচিব ও কর্মকর্তারা উন্নত রাষ্ট্রে ভ্রমণ করে সে দেশের ট্রেন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন। কিন্তু সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করেন না। সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য রেলের সমপোযোগী সিদ্ধান্ত দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন দরকার।
এফএ/এএইচ/জেআইএম