জাগো জবস

ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত সেতু এখন সফল ফ্রিল্যান্সার

পড়াশোনা শেষ করে ইচ্ছা ছিল একটি সরকারি চাকরি করবেন। যতদিন সরকারি চাকরির বয়স ছিল; ততদিন চেষ্টা করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত কোনো চাকরিই হয়নি। মুহূর্তটাতে খুব ভেঙে পরেছিলেন তিনি। কারণ কিছু একটা করে নিজের আলাদা একটি পরিচয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আলাপচারিতায় এমনটিই জানালেন প্রযুক্তি জগতে নিজের পরিচয় গড়ে তোলা সফল ফ্রিল্যান্সার সাজেদা রহমান সেতু।

Advertisement

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা সেতু বলেন, ‘নিজে কিছু করার চিন্তা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো; তখনো আমি ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে তেমন একটা জানতাম না। তবে আগে থেকেই গুগল ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যাস ছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেটে পরে থাকতাম। নিজেকে কীভাবে সাবলম্বী করা যায়, তা নিয়েও রিসার্চ করতে করতে একসময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের সন্ধান পেলাম। তখনো ফ্রিল্যান্সিং, মার্কেটপ্লেস নিয়ে ধারণা ছিল খুবই কম।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে দেখলাম লেখালেখি করে ইন্টারনেট থেকে আয় করা যায়। ব্যাপারটা নিয়ে খুব কৌতূহল হলো। লেখালেখি আমার অন্যতম পছন্দের কাজ ছিল। গুগল থেকে পড়াশোনা শুরু করলাম। কীভাবে লেখালেখি করে আয় করে, কোথা থেকে আয় করা যায় ইত্যাদি। কিছুদিনের মধ্যে একটি বাংলা ওয়েবসাইটের সন্ধান পেলাম, যেখানে একদম নতুনদের জন্য লেখালেখি করার সুযোগ থাকছে, সাথে সম্মানিও। আমার ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল সেখান থেকেই। এরপর ইংরেজি আর্টিকেল লেখা শিখলাম এবং মার্কেটপ্লেসে ঢুকলাম। শুরুর দিকের কিছু কাজ মার্কেটপ্লেসে করলেও এরপর থেকে আছি একজন লোকাল ক্লায়েন্টের সঙ্গে। ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক ক্লায়েন্টের সঙ্গেই কাজ করা হয়েছে। তবে একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে পার্মানেন্টলি কাজ করছি শুরু থেকেই।’

আরও পড়ুন: গ্রোথ মার্কেটিংয়ে অপার সম্ভাবনা আছে: মেহজাবিন বাঁধন 

Advertisement

শুরুর দিকে প্রতিবন্ধকতা ছিল কি না জানতে চাইলে সাজেদা রহমান সেতু বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে ইংরেজি তেমন ভালো লিখতে পারতাম না। অনেক পড়াশোনা এবং প্র্যাকটিস করতে হয়েছে এর জন্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল লেখার টোন। লেখায় আমেরিকান টোন আনতে বেশ সময় লেগেছে। প্রথমদিকে যেহেতু বাংলা আর্টিকেল দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই বেশি একটা সময় লাগেনি। কারণ বাংলায় লেখালেখি আগেও করতাম। একটি আর্টিকেল কীভাবে লিখতে হয় এটি শেখার জন্য সময় লেগেছিল এক সপ্তাহের মতো। এরপর যখন ইংরেজি আর্টিকেল লেখা শুরু করলাম; তখন কাজের সাথে সাথে শিখেছি। কাজ শিখতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু কোন কাজ দিয়ে শুরু করবো এ সিদ্ধান্ত নিতে এক থেকে দুই মাস সময় লেগেছিল।’

যখন কাজ শুরু করলেন; তখন পরিবার বিষয়টি কীভাবে নিতো? জানতে চাইলে এ ফ্রিল্যান্সার বলেন, ‘পরিবার প্রথমে আমার মতোই ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কিছুই জানতো না। এর থেকে এত ভালো কিছু করা সম্ভব এ সম্পর্কে তেমন ধারণাও ছিল না। এমনকি বিশ্বাসও করতো না যে, এটি ক্যারিয়ার হতে পারে। তবে আমি যা-ই করতে চাইতাম, পরিবার অনেক সাপোর্ট করতো। ব্যাপারটি আমার অনেক মেন্টাল রিলিফ ছিল। বাবার অবসরের পর থেকে পরিবারের ফিন্যান্সিয়াল ব্যাপারটা আমি দেখি। এখন পরিবার আমাকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ আমি আসলে জীবনে কিছু করতে পারবো, তা পরিবার কেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারতাম না।’

ফ্রিল্যান্সিংয়ের বড় প্রতিবন্ধকতা কী বলে মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইচ্ছা এবং ধৈর্য। আমার কাছে অনেকেই আসেন যে, কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং করে আমি আয় করছি, তা শেখার জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আগ্রহটা আসলে বেশিদিন থাকে না। শুনতে খুব সহজ শোনা যায়, ঘরে বসে আয় করা যায়। এ কাজের পেছনে কত যে পরিশ্রম, কত রাত জাগা, কত ধৈর্য, কত রিজেকশন, এ ব্যাপারগুলো বেশিরভাগ মানুষই মাথায় আনেন না। তাই খুব দ্রুত এ কাজের প্রতি লেগে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল, আমার কোনো মেন্টর ছিলেন না। মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরতো। কারো কাছে জিজ্ঞেস করবো এমন কাউকে চিনতাম না। ফেসবুকে কিছু ফ্রিল্যান্সিং গ্রুপ ছিল, সেখান থেকেও তেমন কারো হেল্প পাইনি নতুন বলে। কিছু জানতে চেয়ে পোস্ট দিলে বেশিরভাগ মানুষই ডিমোটিভেট করতেন। তাই নিজেই নিজের ভরসা ছিলাম। যতটুকু শিখেছি নিজে নিজেই শিখেছি।’

আরও পড়ুন: কর্মস্থলে আচরণ কেমন হওয়া উচিত 

Advertisement

নারীর জন্য কতটা ইতিবাচক এ পেশা বলে মনে করেন? জানতে চাইলে সেতু বলেন, ‘নারীর জন্য এর চেয়ে বেস্ট কিছু হতে পারে না। কারণ আমরা যা-ই করি না কেন, একটি তিতা সত্য কথা হচ্ছে সংসার সামলাতেই হবে। তাই ঘরে থেকে অফিস করতে পারলে দুদিকেই ব্যালেন্স করা যায়। কোনোকিছুই বাদ দিতে হয় না। আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমি নিজেই। কারণ আজকে আমি যতটুকুই অর্জন করেছি, তা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।’

তিনি বলেন, ‘যখন শুরু করি; তখন আমার নিজের একটা ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটার ছিল না। বোনের ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতাম। সেটাও স্লো ছিল, কাজ করতে অনেক সময় লাগতো। এরপর আয় করা শুরু করি। সেই টাকা জমিয়ে একটা ভালো অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনি। সেই ফোন থেকে কাজ করতাম। এরপর চার-পাঁচ মাস টাকা জমিয়ে একটি নতুন ল্যাপটপ কিনি। এখন সেই ল্যাপটপ থেকেই কাজ করছি। চাইলে একটা ম্যাকবুকও কিনতে পারবো। তাছাড়া পরিবার থেকে সব সময় মেন্টাল সাপোর্ট পেয়েছি, অনুপ্রেরণা পেয়েছি; যা আমার চলার পথকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।’

তরুণ প্রজন্ম এবং নারীর ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে এই সফল ফ্রিল্যান্সার বলেন, ‘নারী এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য পরামর্শ থাকবে, চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত না হতে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে অবশ্যই ডেসপারেটলি লেগে থাকতে হবে, সময় দিতে হবে এবং হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। নারীর জন্য সংসার-বাচ্চা সামলে বাইরে গিয়ে চাকরি করা অনেকটা যুদ্ধের মতো। অনেকেই এসব ভেবে চাকরি ছেড়ে দেন। সমস্যা নেই, ফ্রিল্যান্সিংয়েও চাকরির চেয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। তবে ইচ্ছাশক্তি প্রবল হতে হবে।’

এসইউ/জিকেএস