কৃষি ও প্রকৃতি

পাহাড়ে লটকন চাষে সফলতার স্বপ্ন কৃষকদের

এক সময়ের জংলি ফল লটকন। পাহাড়ের ঢালু আর বনে-জঙ্গলে জন্ম নেওয়া গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকতো এ ফল। কারো কাছেই তেমন কদর ছিল না। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ের বিভিন্ন জনপদে দিনের পর দিন ব্যাপকহারে চাহিদা বাড়ছে টক-মিষ্টি ফলটির। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাহাড়ি বাজার ছাড়িয়ে সমতলের বিভিন্ন জেলায় লটকনের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।

Advertisement

স্থানীয় বাঙালিদের লটকন ফলটি চাকমা ভাষায় ‘পচিমগুল’, মারমা ভাষায় ‘ক্যানাইজুসি’ ও ত্রিপুরা ভাষায় ‘খুচমাই’ নামে পরিচিত। জুন মাসের মাঝামাঝি পাকতে শুরু করে লটকন। একই সময়ে বাজারেও আসতে শুরু করে। এটি উচ্চ ফলনশীল একটি কৃষিপণ্য। গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ডালে থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখা যায় ‘লটকন’ ফল। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ টক-মিষ্টি লটকন ছোট-বড় সবার কাছেই অনেক প্রিয়।

পাহাড়ে আম-লিচুর বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ থেকে পিছিয়ে আছে লটকন। পার্বত্য খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, দীঘিনালা, গুইমারা ও পানছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে স্বল্প-পরিসরে অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে লটকনের চাষাবাদ হচ্ছে। বাড়ির আঙিনা আর পাহাড়ের ঢালুতে গাছে গাছে ঝুলছে লটকনের সোনালি রঙের থোকা।

আরও পড়ুন: পোরশায় ড্রাগন চাষে বছরে আয় কোটি টাকা 

Advertisement

সম্প্রতি পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষে স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। কম পরিশ্রম আর কম পুঁজিতে বেশি লাভের সুযোগ থাকায় লটকন চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন টক-মিষ্টি ফল লটকন প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পানছড়ির যুগলছড়ি মৌজায় সাতশ’র বেশি গাছের দৃষ্টিনন্দন লটকন বাগান গড়ে তুলেছেন শিক্ষিত বেকার যুবক রুমেল মারমা। লিজ নেওয়া জমিতে ঝিরির পাশের লটকন বাগান দেখতে বেশ নজরকাড়া। প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে শুরু করে ডালপালায় ঝুলে আছে অসংখ্য লটকন।

ছড়া এবং ঝিরির ধার লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী জানিয়ে উদ্যোক্তা রুমেল মারমা বলেন, ‘মূলত ঠান্ডা জায়গাতেই লটকন বেশ ভালো হয়। চলতি মৌসুমে ১২ লাখ টাকারও বেশি লটকন বিক্রির আশা করছি।’

লটকন চাষি লিলি খীসা বলেন, ‘লটকন চাষে তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। কম পুঁজি ও কম পরিচর্যায় ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ বছর লটকনের ফলন ভালো হয়েছে। এরই মধ্যে স্থানীয় পাইকাররা লটকন কিনতে শুরু করেছেন। একেকটি গাছের লটকন পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবো।’

Advertisement

আরও পড়ুন: পাহাড়ের কাঁঠালের চাহিদা সমতলে 

মাটিরাঙ্গার নবীনগর গ্রামের মো. চান মিয়ার বাড়ির পাশেই পাহাড়ের ঢালুতে প্রায় অর্ধশতাধিক লটকন গাছ আছে। প্রতিটি গাছে ঝুলছে সোনালি লটকনের থোকা। লটকন বিক্রি থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আয়ের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

ব্যাঙমারা থেকে মাটিরাঙ্গা বাজারে লটকন বিক্রি করতে আসা প্রবীণ কুমার ত্রিপুরা জানান, তার বাড়ির আশেপাশে অন্তত ১০টি গাছে লটকন ধরেছে। এ বছর লটকন বিক্রি করে তিনি লাখ টাকা আয় করার স্বপ্ন দেখছেন।

পানছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার মো. নাজমুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘নরসিংদী, গাজীপুর, নেত্রকোনা ও সিলেটে লটকন বেশি চাষ হলেও পার্বত্য এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বাজারে চাহিদা থাকায় দিন দিন আবাদের পরিমাণ বাড়ছে।’

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, ‘খাগড়াছড়ির প্রায় সব উপজেলায়ই কমবেশি লটকন চাষ হচ্ছে। লটকনের ফলনও ভালো হয়েছে। বেশি পরিমাণে গাছপালা ও ছায়া থাকায় পাহাড়ি এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কম পুঁজি ও পরিশ্রমে বেশি লাভবান হওয়ায় কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’

মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এসইউ/জিকেএস