অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ হলো। পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। মাঝে কেটে গেলো ৮০ বছর। এ পুরো সময়জুড়ে মিষ্টির স্বাদ ও মান বজায় রেখে এখনো কিশোরগঞ্জবাসীর প্রিয় মিষ্টির দোকানের তালিকায় স্থায়ী হয়ে রয়েছে ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার’।
Advertisement
ব্রিটিশ আমল থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের একরামপুর এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে গড়ে ওঠা লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বাদ ও মান এখনো রয়েছে আগের মতোই। তাইতো প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এখনো মিষ্টি ও দই নিতে ছুটে আসেন অনেকেই। এমনকি প্রবাসীরাও দেশের বাইরে নিয়ে যান লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই এত বিখ্যাত এ দোকানের মিষ্টি। অন্য সব সাধারণ মিষ্টির দোকানের মতোই সামনের কাচের বাক্সে সাজানো কাঁচাগোল্লা, রসমুঞ্জরী, সন্দেশ, বরফি, পেড়া, রসগোল্লা, চমচম, দানাদার, লালমোহন, কালোজাম, মালাইকারী, ছানার আমিত্তি, জিলাপি, নিমকি ও দই। প্রায় ৮০ বছর ধরে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির স্বাদ ও মান ঠিক রেখে শহরবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছে প্রাচীন মিষ্টির দোকান ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার’।
আরও পড়ুন: জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল বগুড়ার দই
Advertisement
সারাদিনই সব শ্রেণির ক্রেতার আনাগোনা চোখে পড়ে শহরের অনেক পুরোনো এ মিষ্টির দোকানে। মিষ্টির পাশাপাশি অল্পবিস্তর সকালের নাশারও আয়োজন করা হয় দোকানটিতে। রুটি, ডাল-ভাজি দিয়ে সকালের নাশতা খেতেও আসেন অনেকেই। একপাশে চারটি টেবিল পাতা। পেছনের দিকে নিরিবিলি বসার জন্য আছে দুটি কেবিনও।
দোকানে মিষ্টি খেতে এসেছেন নেদারল্যান্ডস প্রবাসী কবি উৎপল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব উৎসব-পার্বণে মিষ্টির একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এই লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। বিশুদ্ধতা এবং সুলভতার কোনো কমতি নেই এখানে। প্রতিবার বিদেশ থেকে এলেই এখান থেকে যে কত সের (কেজি) মিষ্টি কিনি তা আমি নিজেই জানি না।’
তপন কুমার নামের একজন বলেন, ‘শহরের প্রত্যেকেই এ দোকানের মিষ্টি কোনো না কোনোভাবে খেয়েছেন। এ শহরের শ্রেষ্ঠ মিষ্টির দোকান লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। প্রশাসনিক সব অনুষ্ঠানেও এখান থেকে মিষ্টি সরবরাহ করা। খেতে সুস্বাদু এবং মানও ভালো। এ দোকানের শুকনো মিষ্টি প্রবাসীরা লন্ডন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান।’
আরও পড়ুন: জিআই পণ্য হচ্ছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা
Advertisement
শহরের নগুয়া এলাকা থেকে দই কিনতে আসা বাচ্চু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে শুনে আসছি লক্ষী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি ঐতিহ্যবাহী। নগুয়া থেকে আমার স্যার ২ কেজি দই নেওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।’
চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী এ দোকানে ৪০ বছর ধরে মিষ্টি তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে তিন কেজি দুধ দিয়ে এক কেজি ছানা তৈরি করা যেতো। এখন এক কেজি ছানা তৈরি করতে পাঁচ কেজি দুধ লাগে। কাঁচাগোল্লা, রসমুঞ্জরী, সন্দেশ, বরফি, পেড়া, রসগোল্লা, চমচম, দানাদার, লালমোহন, কালোজাম, মালাইকারী, ছানার আমিত্তি, জিলাপিসহ সবধরনের মিষ্টি আমি বানাতে পারি।’
কথা হয় লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক অলক বসাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঠিক কত সালে দোকানের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ হওয়ার আগেই মানে ব্রিটিশ আমলে দাদা আনন্দ চন্দ্র বসাক প্রতিষ্ঠা করেন দোকানটি। দাদা মারা যাওয়ার পর দোকানটির দেখাশোনা করতেন বাবা রাম নারায়ণ বসাক। বাবা মারা যাওয়ার পর দেখাশোনার ভার ন্যস্ত হয়েছে আমার ও আমার বড় ভাই মানিক চন্দ্র বসাকের ওপর।’
আরও পড়ুন: দেশের বিখ্যাত ৫ মিষ্টি
তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে যখন এ মিষ্টির দোকানের যাত্রা শুরু হয় তখন পাশের নরসুন্দা নদী ছিল খরস্রোতা। শহরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নদীপথে লোকজন যাতায়াত করতেন। তখন দোকানে পাওয়া যেতো রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা, রসমঞ্জুরী (রসমালাই) আর বাদশাভোগ। ব্রিটিশ আমলে কিশোরগঞ্জের কালিয়াচাপড়া সুগারমিল আর যশোদলের পাটকলে পাকিস্তানের করাচির যেসব কর্মকর্তা কাজ করেতেন, তারা বাড়িতে যাওয়ার সময় কাঁচাগোল্লা আর রসমালাই নিয়ে যেতেন। তিনি যখন দোকানের দায়িত্ব নেন তখন দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দর ছিল মিষ্টির।
লক্ষ্মী নারায়ণের সমসাময়িক যেসব মিষ্টির দোকান ছিল সেগুলো সবই হয় বন্ধ হয়ে গেছে, না হয় মালিকানা পরিবর্তন হয়ে সুনাম হারিয়েছে। তবে এখনো সুনামের সঙ্গে টিকে রয়েছে লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার।
মালিক অলক বসাক জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদেরও পছন্দের মিষ্টির দোকান লক্ষ্মী নারায়ণ। ছাত্রজীবনে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তিনি প্রায়ই নাশতা করতে আসতেন এখানে। বঙ্গভবনেও গেছে এ দোকানের মিষ্টি।
আরও পড়ুন: নোংরা পরিবেশে কাঁচাগোল্লা তৈরি, জরিমানা লাখ টাকা
বর্তমানে কাঁচাগোল্লা ৭০০, রসমুঞ্জরী ৫২০, সন্দেশ ৭০০, বরফি ৭০০, পেড়া ৭০০, রসগোল্লা ৩০০, চমচম ২৮০, দানাদার ২৮০, লালমোহন ২৮০, কালোজাম ২৮০, মালাইকারী ৪০০, ছানার আমিত্তি ৪০০, জিলাপি ১৫০, নিমকি ২৪০, দই ২৪০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি। এছাড়া রুটি ১০ টাকা পিস, ডাল-সবজি ২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
দোকানের শুরুতে পরিবারের সদস্যরাই মিষ্টি তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে কারিগরসহ মোট আটজন কর্মী কাজ করেন এখানে। প্রতিদ্নি সন্ধ্যায় মিষ্টি বানানো হয়। দৈনিক গড়ে আড়াই থেকে তিন মণ মিষ্টি তৈরি হয়। ঈদের সময় চাহিদা বেশি থাকায় মিষ্টি তৈরির পরিমাণও বাড়ে।
প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। মিষ্টির পাশাপাশি নাশতা হিসেবে সকাল ১০টা পর্যন্ত পাওয়া যায় রুটি ও ডাল-সবজি।
এ মিষ্টির ব্যবসা করে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে সম্মাননাও পেয়েছেন লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক অলক বসাক।
এসকে রাসেল/এসআর/জিকেএস