ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসে উঠলাম শাহবাগ মোড় থেকে। আট মাসের প্রেগন্যান্সি চলছে আমার। হঠাৎ করেই প্রেগন্যান্সির চারমাস থেকে ডায়েবেটিক ধরা দিয়েছে। ডায়েবেটিক হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম।
Advertisement
আমার স্বামী রেহানের অল্প টাকার চাকরি। এই স্বল্প আয়ের কারণে প্রাইভেটে ডাক্তার দেখানোর কথা বলতেও পারি না। রেহানও নিয়ে যেতে পারে না। আমারও তাকে কোনো বিষয়ে চাপ দিতে কষ্ট লাগে। বেচারা কী করবে? সে তো সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভালো একটা চাকরির জন্য কিন্তু পাচ্ছে না।
আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। যার কারণে আমি স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করি। বাড়তি কোনো খাবার খেতে ইচ্ছে করলেও বলি না। মাঝে মাঝে রেহান নাইট ডিউটি করে। মাসের প্রথমেই রেহান নাইট ডিউটির বাড়তি টাকা দিয়ে কিছু ফল, মিষ্টি ও দুধ কিনে আনে।
এটাই আমাদের প্রথম বাচ্চা। আমরা প্রথম বাচ্চার জন্য আহামরি কিছুই করতে পারছি না। তার জন্য আমার চেয়ে রেহানের মন বেশি খারাপ। আমি রেহানকে সান্ত্বনা দিই। ‘পৃথিবীর সব বাবা তো বড়লোক না রেহান। পৃথিবীতে তোমার মতো হাজারও গরিব বাবা আছে। সন্তানের প্রতি সব বাবারই ভালোবাসা থাকে। তুমি মন খারাপ করো না।’
Advertisement
এই বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে রেহানের ইচ্ছা ছিল না। সে বলতো, ‘আগে ভালো একটা চাকরি পাই। তারপর না হয় বাচ্চা নেওয়া যাবে।’ আমার জেদের কাছে রেহানকে হার মানতে হয়।
রেহানের এই কষ্ট করা দেখে মাঝে মাঝে নিজেকে দোষী ভাবি। আমার কারণেই সে বাড়ির অমতে বিয়ে করে। সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জীবন ফেলে আমাকে নিয়ে এত কষ্টের জীবনযাপন করছে। আমাদের দুই পরিবারের কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই। আসলে দুই পরিবারের কেউই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে না।
রেহানের জন্য আমার অনেক খারাপ লাগে। আজ ওর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। যে রেহান বাড়ির আদরের ছোট ছেলে বলে আহ্লাদে বড় হয়েছে। যে রেহান এক গ্লাস পানি ঢেলে পান করেনি। সে আজ আমার কারণে এ রকম কষ্টের জীবনযাপন করছে। অথচ সে নিজেকে অপরাধী ভাবে। আমি অগোচরে কান্না করি। সে কেমন করে যেন টের পেয়ে যায়। আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে বলে, ‘নাতাশা, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। বিয়ের পর থেকে তোমাকে আমি কষ্টের মধ্যেই রেখেছি। বিশ্বাস করো নাতাশা, আমি অনেক ট্রাই করছি। কোথাও ভালো চাকরি পাচ্ছি না। আমি অপরাধ বোধে ভুগছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।’ আমি তার হাত চেপে ধরি, ‘তুমি এভাবে বলো না প্লিজ। আমার অনেক কষ্ট হয়।’ রেহান আমাকে ওর বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে। আমি ওর বুক থেকে চাঁপা ফুলের গন্ধ পাই।
ডায়াবেটিস হাসপাতাল থেকে শাহবাগ মোড়ে এসে একটা হোটেলে খেতে ঢুকি। প্রচণ্ড গরম পড়েছে আজ। জুলাই মাসের মাঝামাঝি। এত বৃষ্টি হচ্ছে; তবুও গরম কমছে না। হাসপাতাল থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত হেঁটে আসতে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। আমি গরমে ঘেমে ভিজে গেছি। ঠিক যেন গোসল করে উঠলাম। আমার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। রেহান আমাকে তাড়াতাড়ি হোটেলের ভেতরে নিয়ে বসিয়ে ঠান্ডা পানি এনে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। একটু পানি খাইয়ে দিলো। দশ মিনিট লাগলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে। নান, গরুর চাপ আর কোল্ড ড্রিংকস। আমি নান আর চাপের সাথে শসা, টমেটো, ধনেপাতা, বেশি করে পেঁয়াজ, কুচি কুচি করে কাঁচা মরিচ কেটে তাতে বেশি করে লেবু দিয়ে সালাদ খেতে পছন্দ করি। রেহান ওয়েটারকে সুন্দর করে সালাদ বানানোর রেসিপিটা বলে এক প্লেট সালাদ এনে দিতে বললো।ওয়েটার রেহানের রেসিপি অনুযায়ী এক প্লেট সালাদ দিয়ে গেলো।
Advertisement
খাওয়া শেষে আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজ বাসে প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় ঠেলে বাসে ওঠা আমার পক্ষে কোনোরকম ভাবেই সম্ভব নয়। রেহানকে বললাম, ‘দেখো তো সিএনজি কত ভাড়া চায়?’ রেহান সিএনজি ডাকলো। শাহবাগ মোড় থেকে বনশ্রী যেতে পাঁচশ-ছয়শ টাকা ভাড়া চায়। বেশ কয়েকটা সিএনজিকে ডাকা হলো। ভাড়ার কারণে কোনো সিএনজিতে উঠতে পারলাম না। একটা সিএনজির ড্রাইভারকে আড়াইশো টাকা ভাড়া দেবো বলায় সে বললো, ‘বাসে যান ভাই, সিএনজিতে উঠতে হবে না।’ রেহানের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রেহানের অপরাধ বোধে ভোগা চেহারাটা দেখে আমার কষ্টে বুকটা ভেঙে যেতে লাগলো। আমি রেহানকে বললাম, ‘বাদ দাও তো, আমি বাসেই যাবো। সিএনজিতে উঠলে আমার দম বন্ধ হয়ে যায়।’
একটা বাস এলো। বাসটাতে উঠতে পারলাম। ভিড় একটু কম। কন্ট্রাক্টর ছেলেটা আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি একটা সিট খালি করে দিলো। সিটে বসতে বসতে ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানালাম।
বাস চলতে লাগলো। মেঘ করেছে খুব। বৃষ্টি হবে বোধহয়। বাসের জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসটাতে আমার ক্লান্ত শরীরটা জুড়িয়ে গেলো। কখন যে বাসের জানালার গ্লাসটায় মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না। ব্রেক করাতে ঘুমটা ভাঙলো। অনুভব করলাম, জানালার গ্লাসে আমার মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে রাখা। বুঝতে অসুবিধা হলো না, বাসের ঝাঁকুনিতে আমি যেন মাথায় ব্যথা না পাই, সেজন্য রেহান আমার মাথার নিচে হাত দিয়ে রেখেছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা পানি।
এই ভালোবাসার জন্যই আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমি রেহানের সাথে কাঁটাতে চাই হাজার বছর। পেছনের সিটে বসা এক কিশোর প্রেমিক-প্রেমিকা মুঠোফোনে গান শুনছিলো। গানের কথাগুলো বুকে বিঁধে গেলো—‘এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়স্বপ্ন মধুর মোহে,এই জীবনে যে কটি দিন পাবোতোমায় আমায় হেসে খেলে,কাটিয়ে যাবো দোঁহেস্বপ্ন মধুর মোহে।’
এসইউ/জেআইএম