মাত্র সাত-আট মাস আগের কথা। দিল্লির উপকণ্ঠে গ্রেটার নয়ডার কাছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে চাষিরা ট্রাক্টর বোঝাই করে টমেটো এনে রাস্তায় উপুড় করে ফেলে দিচ্ছিলেন। গাড়ির চাকায় থেঁতলে লাল হয়ে উঠছিল আগ্রা অভিমুখী সেই রাজপথ!
Advertisement
উত্তর প্রদেশ আর সংলগ্ন হরিয়ানার সেই প্রতিবাদী কৃষকদের বক্তব্য ছিল, লাখ লাখ রুপি খরচ করে তারা ক্ষেতে টমেটো চাষ করেছেন। কিন্তু বাজারে বেচতে গেলে কেজিতে মাত্র এক থেকে দুই রুপি দাম পাচ্ছেন। ক্ষেতের ফলন মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচটুকুও উঠছে না তাতে!
ফলে সরকারি কৃষিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তারা বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলনের সেই পথ। অভাবগ্রস্ত টমেটো চাষিদের কৃষিঋণ মওকুফ করার দাবিও উঠেছিল জোরেশোরে।
অথচ এই মুহূর্তে ভারতজুড়ে সম্পূর্ণ অন্য ছবি। তরিতরকারির বাজারে টমেটোর চেয়ে দামি পণ্য আর একটিও নেই!
Advertisement
আরও পড়ুন>> হু হু করে বাড়ছে টমেটোর দাম, লুট ঠেকাতে দোকানে নিরাপত্তারক্ষী
দিল্লি, মুম্বাই বা কলকাতার মতো মেট্রো শহরগুলোতে খুচরা বাজারে টমেটোর দাম যেখানে দিন পনেরো আগেও ছিল ৪০ রুপি কেজি, এখন সেই দামই গিয়ে ঠেকেছে ১৫০ থেকে ২০০ রুপিতে!
বাজারে সবজিওয়ালাদের কাছে এতদিন টমেটোর ঝুড়ি হেলাফেলায় পড়ে থাকতো, দু’একটি গড়িয়ে গেলেও কেউ মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু তারাই এখন সযত্নে কোলের কাছে টমেটোর বাক্স নিয়ে আগলাচ্ছেন, যেন হীরে-জহরতের ভাণ্ডার!
টমেটোর দাম জিজ্ঞেস করলে এতদিন সবজিবিক্রেতারা কেজিতেই দাম বলতেন। কিন্তু এখন তারা পোয়া (২৫০ গ্রাম) হিসেবে দাম বলছেন। দিল্লির কোনো কোনো বাজারে পিস হিসেবেও (জোড়া টমেটো ২৫ রুপি!) বিক্রি শুরু হয়েছে।
Advertisement
টমেটো শুধু মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তর মাথায় আগুন লাগায়নি, ভারতে ফাস্ট ফুড জায়ান্ট ম্যাকডোনাল্ডসের রান্নাঘরেও ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলে দিয়েছে!
বহুজাতিক এই কোম্পানিটি রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ভারতে তাদের বার্গারসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় আইটেমে আপাতত টমেটো ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তারা যে ধরনের বাছাই করা টমেটো খোঁজে, তার জোগান নেই!
আরও পড়ুন>> আড়াই লাখ টাকার টমেটো চুরি, থানায় ছুটলেন কৃষক
কর্ণাটক থেকে টমেটো বোঝাই একাধিক ট্রাক লুট হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। কৃষকরা বলছেন, তার প্রতিটাতে অন্তত আড়াই থেকে তিন লাখ রুপি দামের টমেটো ছিল।
এবং যথারীতি টমেটোর অগ্নিমূল্য নিয়ে মিম, কার্টুন আর পোস্টে ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া!
ফলনের ভরাডুবিভারতে টমেটোর দাম এভাবে রাতারাতি বেড়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু কালোবাজারি বা হোর্ডিংকে দায়ী করা হচ্ছে না। মোটামুটিভাবে সবাই একমত যে, বাজারে টমেটোর জোগান প্রায় নেই বলেই এই নজিরবিহীন সংকট।
আর আচমকা এই ‘শর্ট সাপ্লাই’য়ের মূলে রয়েছে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা এবং একটি বিশেষ ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণ।
ন্যাশনাল সিড অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সাবেক অধিকর্তা ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রশেখর সিং জানান, চলতি বছরের ‘অদ্ভুত’ ওয়েদার প্যাটার্ন, বিশেষ করে অসময়ের বৃষ্টি আর একের পর এক সাইক্লোন টমেটো চাষের বিরাট ক্ষতি করেছে।
তিনি বলেন, ভারতের দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি টমেটো হয়। কিন্তু ক্ষেতে পানি জমে থাকায় ওই সব এলাকায় এবার টমেটোর ফলন মোটেও ভালো হয়নি।
আরও পড়ুন>> পশ্চিমবঙ্গে সবজির দামে আগুন
এর পাশাপাশি উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় টমেটো চাষ এই মৌসুমে ছত্রাকের আক্রমণের মুখে পড়েছে। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলার কৃষক অরবিন্দ মালিক জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রথম লক্ষ্য করেন, তার ক্ষেতের টমেটো গাছগুলোর পাতা হঠাৎ করে শুকিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি কৃষি বিশেষজ্ঞরা আমাদের জানিয়েছেন, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামার জন্যই টমেটো ক্ষেতে এক ধরনের ছত্রাক ধরেছে। তখন তাদের পরামর্শে আমরা খুব দামি ফাঙ্গিসাইড কিনে স্প্রে করি। কিন্তু তারপরও এবার একেবারেই ভালো ফলন পাইনি। আমার জমিতে প্রতি বছর যেখানে ৩০ হাজার কেজি টমেটো হয়, এবারে তার অর্ধেকও হয়েছে কি না সন্দেহ।
সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হলো, গত মার্চ-এপ্রিল মাসে যে টমেটো তিনি দেড়-দেই রুপি কেজিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু আজ যখন দাম আকাশ ছুঁয়েছে, তখন তার হাতে বিক্রি করার মতো এক কেজিও টমেটো নেই!
ফলে বাজারে আজকের এই চড়া দাম থেকে ভারতের ক্ষুদ্র টমেটো চাষিরা যে লাভবান হচ্ছেন না, তা ধরে নেওয়াই যায়।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/