আশি-ঊর্ধ্ব সাহেরার স্বামী নেই ১৭ বছর। আছেন তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। কিন্তু সন্তানদের সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে মতবিরোধে ঠিকমতো জোটে না খাবার। সন্তানদের কাছে গুরুত্ব সম্পদ, তাই মায়ের দায়িত্ব নিতে চান না কেউ। বাড়ির উঠানে একটি টিনের ছাপড়া ঘরে ঠাঁই মিলেছে তার। একই জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ, চলে খাওয়া গোসলও। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করতে গিয়ে ধুকে ধুকে মরছেন এ বৃদ্ধা।
Advertisement
সাহেরা খাতুন মেহেরপুরের গাংনীর কল্যাণপুর উত্তর পাড়ার মৃত খেলাফত মন্ডলের স্ত্রী। ১৭ বছর আগে মারা যান স্বামী। তার বড় ছেলে হকাজ্জেল কৃষক, মেজ ছেলে তুষার ও ছোট ছেলে হানিফ প্রবাসী। অনেক কষ্টে সন্তানদের বড় করেছেন। আশা ছিল তারা বৃদ্ধ মায়ের দেখাশোনা করবে। কিন্তু সন্তানেরা সম্পদ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধা মাকে দেখভাল করেন না কেউ।
স্বামীর রেখে যাওয়া জমির দুই আনা অংশ হিসেবে ৫ কাঠা জমি পান সাহেরা। ওই জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকা নেন তার মেয়ে মেহেন্নীগার। একইসঙ্গে নিয়ে নেন মায়ের গলার চেইন ও কানের পাশা।
এদিকে কৌশলে পাঁচ বোনকে ফাঁকি মায়ের কাছ থেকে পাঁচ কাঠা জমি লিখে নেন তিন ছেলে। মেয়েদের কাছে থাকা অর্থ ও গয়না না পাওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয় সাহেরাকে। অপরদিকে মেয়েরাও কোন খোঁজ নেন না। সব মিলিয়ে সাহেরার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার।
Advertisement
সাহেরার দেবর হারেজ আলী বলেন, ভাই মারা যাওয়ার পর সাহেরা খাতুন নিজেই রান্নাবান্না করে খেতেন। তার নিজের একটা গাভি ছিল। সেটি বিক্রি করে নগদ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন কাউছার মেম্বারের কাছে। সাহেরা অসুস্থ হওয়ার পর ১০ হাজার টাকা খরচ করেন। বাকি টাকা থেকে যায় মেম্বারের কাছে। আবার বয়স্কভাতার টাকাও সন্তানরা ভাগ করে নেন।
প্রতিবেশী বাবলু বলেন, মায়ের ভরণ-পোষণের বিষয়ে তিন ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়। ১০ দিন করে একেক সন্তান মাকে খাওয়াবে ও যত্ন নেবে। অথচ কেউ সঠিকভাবে তা করেন না। যার কাছেই যাক সেখানেই অবহেলার পাত্র তিনি। ঠিকমতো খাবার দেন না। করেন না গোসলের ব্যবস্থা।
প্রতিবেশী সাজিয়া খাতুন বলেন, সন্তানদের কারও কোনো অভাব নেই সংসারে। মেয়েরাও বেশ ধনী। টাকা-পয়সার কারণে বৃদ্ধ নারীকে কেউ দেখে না। শনিবার ছেলে ও মেয়েদের দ্বন্দ্বের কারণে তাকে রাস্তায় রেখে গেছে। ছেলের বৌরা মেয়ের বাড়িতে দিয়ে এলে তারাও বাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে রাখে। স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদে অবশেষে ছেলের বৌরা বাড়িতে নিয়ে যান।
তবে মেজ ছেলের স্ত্রী রুপিয়া জানান, কোনো অবহেলা করা হয় না। সবাই যত্ন নেন। তবে মেয়েরা সম্পদ থেকে বঞ্চিত ও তার গচ্ছিত টাকা হাতিয়ে নিতে না পেরে মাকে দেখভাল করেন না। উল্টো নানা ধরনের ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে সম্মানহানি করেন।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, যতই আদর যত্ন করা হোক এরপরও বাড়ির পাশে মেয়ে আছে তার কাছে যাওয়া ও দেখার জন্য ছটফট করেন। কিন্তু মেয়েদের খবর দেওয়া হলে তারা কেউ আসে না। এক পর্যায়ে শনিবার মেয়ের বাড়িতে দিয়ে আসা হয়। সম্পদ না পাওয়ার কারণে মেয়েরা বাড়িতে না রেখে রাস্তায় রেখে যায়। পরে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
এ বিষয়ে সাহেরার মেয়ে মেহেন্নীগার বলেন, মাকে আমার বাড়িতে নয়, বাড়ির পাশে রেখে যায় ভাবিরা। এরপর তাদের বাড়ির পাশে রেখে আসা হয়। মায়ের জমিজমা ফেরত দিলে আমরা মায়ের সেবা যত্ন করবো। মায়ের বিষয় নিয়ে গ্রামে ও কয়েকবার পুলিশ ক্যাম্পে সালিশ হলেও কোনো সমঝোতা হয়নি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কাউছার মেম্বার বলেন, তার কাছে ৪০ হাজার টাকা গচ্ছিত আছে। যে কোনো সময় চিকিৎসা বা তার দাফন কাফনে টাকাগুলো লাগতে পারে। তবে মেয়ের কাছে রাখা টাকাগুলো দিচ্ছেন না তারা। সালিশ বৈঠকেও কোনো সুরাহা হয়নি।
মেহেরপুর গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসজে/জেআইএম