সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের প্রধান মসজিদের সামনে পবিত্র ঈদুল আজহার দিন প্রকাশ্যে কোরআন শরিফে আগুন দেন ইরাকি বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি। সালওয়ান মোমিকা নামের ওই ব্যক্তি পাঁচ বছর আগে অভিবাসী হিসেবে সুইডেনে আসেন এবং সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন যে, এখন তার সুইডিশ পাসপোর্ট রয়েছে।
Advertisement
তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক বলে দাবি করেন। পশ্চিমা সমাজে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং নারী অধিকারের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে কোরআন শরিফ সাংঘর্ষিক এবং তাই এটা নিষিদ্ধ করা উচিত। কিন্তু সুইডেনে প্রকাশ্যে কোরআনের অবমাননার কাজটি তিনিই প্রথম করেছেন এমন নয়। এরও আগেও বেশ কয়েকবার সুইডেনে কোরআন পোড়ানো হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে মালমো শহরে স্ট্রাম কুর্স নামের একটি কট্টর ডানপন্থি সংগঠন কোরআন শরিফ পোড়ায় এবং এর জেরে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।
আরও পড়ুন: বিয়ের দেনমোহর হজ, অবশেষে স্বপ্নপূরণ
স্ট্রাম কুর্স অভিবাসন-বিরোধী ও ইসলাম-বিদ্বেষী বলে পরিচিত এবং সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন রাসমুস পালুদান নামের একজন উগ্রপন্থী। চলতি বছর জানুয়ারিতে এবং ২০২০ সালেও সুইডেনে একই রকম ঘটনা ঘটেছে।
Advertisement
ডানপন্থার উত্থানসুইডিশদের সঙ্গে ইসলামের প্রথম পরিচয় হয় ১৬শ থেকে ১৭শ শতকে। সে সময় দেশটি সামরিক শক্তি অর্জন করে। সুইডিশ সাম্রাজ্যের প্রসারের সাথে সাথে তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও চরম আকার ধারণ করে। সুইডিশরা যদিও মূলত ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু ১৬শ শতকে দেশটি একটি লুথেরান প্রটেস্টান্ট দেশে পরিণত হয়। ১৬৬৫ সালে সুইডিশরা তার পিতৃপুরুষের ধর্মমতকে বেআইনি ঘোষণা করেন।
সে সময় ক্যাথলিক ও মুসলমানদের প্রকৃত খ্রিস্টান ধর্মের শত্রু হিসেবে দেখা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে সুইডেনে উদারনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। দেশটি পরিচালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ আইনের আওতায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে সুইডিশদের মনোভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করছেন সুইডেনের ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওমর মুস্তাফা।
তিনি বলছেন, সুইডেনে ইসলাম বিদ্বেষ ক্রমশই বাড়ছে। আর সেটার বহিঃপ্রকাশ শুধু ইন্টারনেটে নয়, বাস্তবে মুসলমানদের জীবনে প্রতিনিয়ত তা ঘটছে। কোরআন পোড়ানোর সর্বশেষ ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি নানা ধরনের বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন, রাস্তাঘাটে মুসলিম নারীদের হেনস্থা, মুসলিমদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এবং মসজিদেও হামলার ঘটনা ঘটছে। সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টি মূলত উগ্র ডানপন্থী দল যারা এক সময় নাৎসি ধ্যানধারণায় বিশ্বাস করতো। মাত্রা কম হলেও এরা এখনও বর্ণবাদী এবং অভিবাসনবিরোধী।
Advertisement
অভিবাসী-বিদ্বেষ এবং ইসলাম-বিদ্বেষফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং সুইডেনে ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া। এর একজন গবেষক আবদেলকাদের এনজি। তিনি দেখিয়েছেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে মুসলিমদের ব্যাপারে সুইডিশদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। ২০১৪ সালে এক জরিপে দেখা যায় ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন ইসলাম ইউরোপীয় জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে একটি হুমকি। ২০১৬ সালে আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ সুইডিশ মুসলিমদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন এবং ৫৭ শতাংশ মনে করেন শরণার্থীরা সুইডেনের জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি।
আর এই বিশ্বাসকেই কাজে লাগাচ্ছে উগ্র-ডানপন্থি দলগুলো। শুধু সুইডেন না, বিশ্বজুড়েই ইসলাম-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বার্কলে পলিটিক্যিাল রিভিউতে এক নিবন্ধে লিখছেন জুডি সাফেইন।
তিনি বলেন, বিশেষ করে সিরিয়া এবং ইরাকের মতো দেশের মুসলিমরা যারা নিজ দেশে যুদ্ধাপরাধ এবং আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘জেনোফোবিয়া’ বা বিদেশিদের সম্পর্কে আতঙ্ক। মানুষ নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়, জীবিকা এবং এমনকি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে এখন ‘অন্যদের’ সাহায্য করতে অস্বীকার করছে। এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে সুইডেনের ঘটনাও একই রকম।
শরণার্থী কিংবা অভিবাসীদের প্রতি মনোভাব বদলে যাওয়ার আরেকটি দিক উল্লেখ করেছেন জুডি সাফেইন। রাশিয়ার অভিযানের পর ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের সাথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থীদের তুলনা করে তিনি লিখেছেন, সুইডেনের সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক নেতারা বারবার উল্লেখ করেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী নয়, এরা ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থী ... এরা খ্রিস্টান এবং এরা শ্বেতাঙ্গ। একারণে ইউরোপে অ-খ্রিস্টান এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণাসূচক অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
ইরাকি বংশোদ্ভূত সালওয়ান মোমিকা কিন্তু হঠাৎ করে কোরআন পোড়ানোর পরিকল্পনা করেননি। মসজিদের সামনে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য তিনি অনেক আগে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন।
কিন্তু পুলিশ অনুমতি না দেওয়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং এ নিয়ে তিন মাস ধরে মামলা চলে। শেষ পর্যন্ত আদালত তাকে অনুমতি দিয়েছিল। সুইডিশ সংবিধান অনুযায়ী এধরনের বিক্ষোভ করার অধিকার তার রয়েছে।
এই ঘটনা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাতে সুইডিশ সরকার বেশ হতচকিত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ‘চরম ইসলাম-বিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে সালওয়ান মোমিকার কঠোর সমালোচনা করে। কিন্তু এই ঘটনার পর বাক-স্বাধীনতার সীমা নিয়ে সুইডেনে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক।
সুইডিশ পুলিশ এখন বলছে, শুধু কোরআন না, তাওরাত এবং বাইবেল পোড়াতে চায় এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিক্ষোভের জন্য তারা নতুন আবেদনপত্র পেয়েছে। সুইডেনের কিছু উদারপন্থী ভাষ্যকারও এখন মনে করছেন যে এধরনের বিক্ষোভকে ঘৃণাসূচক কাজ হিসেবে গণ্য করা উচিত। কারণ কোন নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে লক্ষ্য এসব করা হচ্ছে, যা সুইডিশ আইনে নিষিদ্ধ।
অন্যদিকে, সুইডেনের ভেতরে অনেকেই বলছেন যে ধর্মের সমালোচনা করা, এমনকি সেটি যদি ওই ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে আপত্তিকর বলেও মনে হয়, তাহলেও তার অনুমতি দেওয়া উচিত।
পাশাপাশি তারা বলছেন, ব্লাসফেমি আইন ফিরিয়ে আনার জন্য সুইডেনের ওপর যে চাপ দেওয়া হচ্ছে তাও প্রতিরোধ করা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষ সুইডেনে কয়েক দশক আগে আইনটি বাতিল করা হয়েছিল।
সুইডেনের ন্যাটো স্বপ্নস্টকহোমে ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় ন্যাটো জোটে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়ার আশা আরেকবার ধাক্কা খেতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
ইউক্রেনে রুশ অভিযানের পর সামরিক জোটনিরপেক্ষতার দীর্ঘদিনের নীতি বিসর্জন দিয়ে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড গত বছর ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল।
সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ন্যাটোর সব সদস্য রাষ্ট্রের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুরস্ক ও হাঙ্গেরি এখনও সুইডেনের আবেদনের প্রতি সমর্থন জানায়নি। তুরস্কের এরদোয়ান সরকার বারবার অভিযোগ করেছে যে, নিষিদ্ধ ঘোষিত বিদ্রোহী দল কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির বা পিকেকে-কে এবং আরও কিছু তুর্কি বিরোধী দলকে সুইডিশ সরকার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।
আঙ্কারা এদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। এদের বিরুদ্ধে সুইডিশ সরকার ব্যবস্থা না নিলে তারা ন্যাটোতে যোগদানে সমর্থন জানাবে না। এর বিরুদ্ধে গত জানুয়ারি মাসে স্টকহোমে তুর্কি দূতাবাসের সামনে একটি বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়। সে সময়ও কোরআন শরিফ পোড়ানো হয়।
ওই বিক্ষোভের আয়োজন করেছিলেন কট্টর ডানপন্থী ও ইসলাম-বিরোধী নেতা রাসমুস পালুদান। ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ান বলছে, পালুদানের ওই বিক্ষোভের জন্য সরকারি পারমিটের ৩২০ সুইডিশ ক্রোনার অর্থ জমা দিয়েছিলেন ক্রেমলিনপন্থি টিভি চ্যানেল আরটি’র সাবেক সাংবাদিক চ্যাং ফ্রিক।
তিনি এখন সুইডেন ডেমোক্র্যাট পার্টির খবর নিয়মিতভাবে কাভার করেন। পারমিটের অনুমতির জন্য অর্থ দেওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, কাউকে কোরআন পোড়াতে বলেননি।
সুইডিশ মিডিয়া সে সময় জানিয়েছিল, ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার সুইডিশ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে ওই বিক্ষোভের পেছনে কাজ করেছে ক্রেমলিন সরকার। ফলে এবারও তেমন কোন লক্ষ্য ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবাদমাধ্যমে।
আরও পড়ুন: জেনিন ছাড়ছে ইসরায়েলি বাহিনী
ওদিকে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান গত সোমবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ন্যাটোতে সুইডেনের সদস্যপদ অনুমোদন করতে তার দেশ এখনও প্রস্তুত নয়। তিনি বলেছেন, ‘হোম-ওয়ার্ক’ শেষ করার জন্য স্টকহোমকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
তিনি বলেন, স্টকহোমে আমাদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের ওপর জঘন্য হামলা আমাদের সকলকে ক্ষুব্ধ করেছে। ২০০ কোটি মুসলিমের অনুভূতির প্রতি এই বিকৃত অবহেলা কোনো মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না, চিন্তার স্বাধীনতা তো নয়ই। সব মিলিয়ে সুইডেনের এখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা।
টিটিএন