দল্যুজ শুরু করেছেন দুটো শব্দের সাংঘাতিক ব্যাখ্যা দিয়ে—জেনারিলিটি এবং রিপিটেশন। দুটো শব্দ এক নয়। জেনারিলিটি শব্দটা বুঝতে হবে একধরনের সাধারণ্যতা বা সামান্যতার ভেতর দিয়ে। ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের মধ্যে যখন অতি কমন বা সাধারণ বিষয় থাকে তখন সেটা জেনারিলিটি। যেমন বিজ্ঞানে আমরা যেটাকে ‘ল’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছি। প্রকৃতির দিকে তাকালে ঘুরে ঘুরে যখন আমরা একই দৃশ্য দেখি, ব্যতিক্রমটি দেখি না; তখন সেটা ল হিসেবে মেনে নিই। জেনারিলিটিকে তিনি দুটো পর্বে ভাগ করেছেন, একটা সাদৃশ্যের গুণগত দিক; অন্যটা সমতার পরিমাণগত দিক।
Advertisement
জেনারিলিটি এমন একটা বিষয় যে, একটা ঘটনা অন্য বিষয়ের সাথে পারস্পারিক বিনিময়যোগ্য; বিনিময় করলে এর ক্ষতি হয় না। এ কারণেই সম্ভবত অভিজ্ঞতাবাদীরা তাদের অভিজ্ঞতাকে সাধারণ বা সবার অভিজ্ঞতা হিসেবে মেনে নেন। বিজ্ঞান এ কারণেই বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কারের জন্য এ সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করেন এবং সূত্র আবিষ্কার করেন। অন্যদিকে রিপিটেশন হচ্ছে খুবই দরকারি এবং অনুমিত আচরণ, যা কি না একটার সাথে আরেকটা বিনিময়যোগ্য নয়।
দর্শন কীদর্শন পঠনের প্রারম্ভিক প্রশ্ন নিয়ে খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, দর্শন কী? আমরা এর খুব প্রচলিত উত্তর মুখস্থ করে রেখেছি। দর্শন হচ্ছে এই জগৎ আর জীবন নিয়ে যতসব মৌলিক সমস্যা আছে, তার যুক্তিগত অনুসন্ধান। ইত্যাদি। কিন্তু জিল দল্যুজ এ নিয়ে রীতিমত একটা বই লিখে ফেলেছেন, What is philosophy? শিরোনামে। দর্শন কী, তিনি জানাচ্ছেন, মানুষ মনে করে এ ধরনের প্রশ্ন সম্ভবত জীবনের শেষভাগের প্রশ্ন। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, মনের ভেতর আর কোনো প্রশ্ন থাকে না; তখন মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্ন উদয় হয়। কিন্তু দল্যুজ ও গাত্তারি এর বিরোধিতা করে বলেন, দর্শন এ ধরনের ধ্যানমুখী বা আত্ম-অনুসন্ধানী বিষয় নয়। দর্শন জ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে একেবারে আলাদা। একজন ঔপন্যাসিক যেমন গল্পের প্লট তৈরি করেন, বিজ্ঞানী যেমন কাজ করেন পরীক্ষণমূলক ডাটা বা উপাত্তের ওপর, দার্শনিক তেমন না। দার্শনিক হচ্ছেন ধারণা বা কনসেপ্টের কারিগর। তাঁর মতে, দার্শনিক হচ্ছেন ‘‘is the concept’s friend; he is potentiality of the concept”। দল্যুজ এবং গাত্তারির মতে দর্শনের উচিত সব ধরনের বিশৃঙ্খলতাকে এড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলার সীমানাকে নির্ধারণ করা; যা দর্শন নয় সেটাকে চিহ্নিত করা।
দল্যুজ এবং গাত্তারির সর্বশেষ যৌথ লেখা বইটির ইংরেজি অনুবাদকের কাছে একটি চিঠিতে এই বই লেখার কারণ জানিয়েছিলেন দল্যুজ। তিনি জানিয়েছিলেন, কেন তিনি স্পিনজাকে দর্শনের বরপুত্র ভাবেন। আর সাথে সাথে সর্বেশ্বরবাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেই তিনি বইটা লিখতে কলম ধরেছেন। তবে আরও অনেক বিষয় নিয়ে তিনি এই নাতিদীর্ঘ বইটা লেখেন। দর্শন হচ্ছে, তাঁর মতে, এক ধরনের কর্মধারা যা কি না কনসেপ্ট তৈরি করে, আবিষ্কার করে এবং তাকে সাজিয়ে তোলে। অনেক গবেষক যুক্তি দেখিয়েছেন, কোনো কনসেপ্ট তার স্থায়ী অর্থ নিয়ে আমাদের কাছে হাজির হয় না বরং একটা কনসেপ্ট আরেকটার জন্ম দেয়। তাই এটা একটা ভাবনার শেকল বানিয়ে তোলে, যা চলমান এবং অনন্তমুখী। তিনি বলতে চাইছেন, ধারণাগুলো হচ্ছে এক একটা মাধ্যম যার সাহায্যে দার্শনিকেরা কাজ করেন। চিত্রশিল্পীরা যেমন কাজ করেন লাইন এবং রং নিয়ে, সংগীতশিল্পীরা কাজ করেন শব্দ ও ধ্বনি নিয়ে, ফিল্ম মেকাররা ইমেজ নিয়ে; তেমনই দার্শনিকেরা কনসেপ্ট বা ধারণা নিয়ে।
Advertisement
তাই দর্শন শুধু কনসেপ্ট বা ধারণার ব্যাখ্যা। কিন্তু যে ধারণা নিয়ে কনসেপ্ট তৈরি হয়, সেটা বহুবিধ ধারণার সমন্বিত অভিঘাত। অর্থাৎ কনসেপ্ট মানেই বহু ধারণার জটিল সংমিশ্রণ। যেমন ধরুন, দেকার্তের সুবিখ্যাত কনসেপ্ট, “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি”। এখানে “আমি” শব্দটা তিনটা অবস্থা তৈরি করেঃ সন্দেহ বা সংশয়, চিন্তা এবং সত্তা বা অস্তিত্ব। প্রথমে আমি আমার চারপাশের সবকিছুকে সন্দেহ করছি, আমি চিন্তা করছি অর্থাৎ আমি একটা চিন্তাশীল সত্তা এবং আমার অস্তিত্ব বা বিং। প্লেটো যেমন ছিলেন এই ধারণা তৈরি করার কারিগর। প্লেটো যেমন পরম সত্তা বোঝাতে “এক” শব্দটা ব্যবহার করেছেন। উপনিষদে যেমন এক ও অদ্বিতীয় সত্তার ধারণা দেওয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় পারমানাইডিস বলেন, এই একক শব্দটার দুটো উপাদান আছেঃ একটা সত্তা অন্যটা অসত্তা।
প্লেটো যেমন বলেছেন, কোনো ‘ভাব’ অবশ্যই অনুধ্যানমূলক হতে হবে। কিন্তু দল্যুজ এর বিরোধিতা করে বলেন, আপনি যদি ‘ভাব’ কী সেটাই না জানেন, তাহলে কীভাবে সেই ‘ভাব’ নিয়ে অনুধ্যান করবেন? কাজেই কোনো বস্তু সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার আগে দেখতে হবে সে সম্পর্কে আমার ধারণা কী! মূল কথা হচ্ছে, কন্টেমপ্লেশনের আগে কনসেপ্ট। কোনো বিষয়ের নির্দিষ্ট প্রতিফলনের জন্য দর্শনের দরকার নেই। আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, দর্শনের কাজ হচ্ছে এই প্রতিফলের একটা শৈল্পিক উপায় কিন্তু আদতে তা না। একজন গণিতবিদ কিন্তু চিন্তার সময় কখনো অন্য একজন দার্শনিকের কাছে যান না; একজন চিত্রশিল্পীও গভীর ধ্যানমগ্নের সময় দার্শনিকের কাছে হাত বাড়ান না। যদি বলা হয়, এসব মানুষের ওই মননশীল চিন্তাই হচ্ছে দর্শন, তাহলে বিষয়টা কিন্তু হাসির উপকরণ হয়ে ওঠে। তাই দার্শনিকেরা কিন্তু রিফ্লেক্টিভ নন বরং ক্রিয়েটিভ।
দর্শনের কাজ কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করা নয়। যোগাযোগ স্থাপন মানে মানুষের মাঝে এক ধরনের সমঝোতা স্থাপন করা। দল্যুজ মনে করেন, দর্শনের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মাঝে কত ধরনের মতানৈক্য থাকতে পারে, সেটার মূলসূত্র অনুধাবন করা। এবং সেটাকে উৎসাহিত করা। এই মতভিন্নতাই আমাদের সৃজনশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৯০ সালে দল্যুজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা শুধু অন্যের ধারণা চুরি করার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু নতুন মৌলিক ধারণা তৈরি করা সব সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মনে রাখতে হবে, দর্শনের কাজ হচ্ছে ধ্বংসাত্মক কাজ, পুরোনো সবকিছুর প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো এর প্রাধনতম দায়িত্ব। এখানে এই সৃজনশীলতা বলতে এই ধ্বংসাত্মক কাজকেই ইঙ্গিত করেছেন। তাঁদের নিজের কথায়, ‘‘Philosophy is the art of forming, inventing and fabricating concepts, palpating the differences that disrupt all projects of identification’’।
দল্যুজ ও গাত্তারির বরাত দিয়ে দানিয়েল স্মিথ এ আলোচনাকে সুবিস্তৃত করেছেন। দর্শনের কাজকে তিনি অন্তত পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেনঃ দ্বান্দ্বিকতা, নন্দনতাত্ত্বিক, নীতিবিদ্যক, রাজনৈতিক ও বিশ্লেষণ।
Advertisement
ক. দ্বান্দ্বিকতা (ধারণা তত্ত্ব) দল্যুজ এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতার আবহে নতুন এক ধারণার প্রস্তাব করেন, যেটা প্লেটোর অপরিহার্য সমসাত্ত্বিক ধারণা থেকে আলাদা, কান্টের নিয়ন্ত্রক মডেল থেকে আলাদা, আলাদা হেগেলের বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিক পরিণতির থেকে। তাহলে কী? তাহলে সেটা দল্যুজের ভাষায়, problematic and genetic model of difference। একটু গুছিয়ে বললে দাঁড়ায়, আইডিয়া বা ধারণা উদ্ভব হয় কোনো বস্তুর সারধর্ম থেকে। কিন্তু কেউই সেই আইডিয়াতে পৌঁছাতে পারেন না, যদি কি না এ ধরনের প্রশ্ন করা হয়, যেমন সক্রেটিক প্রশ্ন, “এটা কাকে বলে...” তাহলে। এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পেছনে এক ধরনের অতীন্দ্রিয় ও শাশ্বত ঠিকানায় পৌঁছানোর একটা বাসনা লুকিয়ে থাকে। বরং যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘কোনটা’, ‘কোথায়’, ‘কেমন করে’, ‘কতগুলো’, ‘কোন দৃষ্টিকোণ থেকে’ ইত্যাদি। তাহলে উত্তরটা নিশ্চিতভাবে একটা দেশ-কালিক সীমানার মধ্যে ঘুরে ফেরে। আবার কান্ট এই আইডিয়ার প্রশ্নে আমাদের নিয়ে গেছেন বোধের সীমানায় যেখানে ধারণাগুলো এক একটা বিভাজনের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন, স্বগতসত্তার ঠিকানায় কান্টের ভাষায় foci বা horizons-এ। দল্যুজ এর বিপরীতে এমন একটা তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছেন, যা মূলগতভাবে উদ্ভব সংক্রান্ত বা জেনেটিক এবং অবশ্যই সেটা যে কোনো শর্তের বাইরে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ধারণার ব্যাখ্যা দিতে দল্যুজ কিন্তু লিবনিজের ক্যালকুলাস অনুসরণের পক্ষপাতী। সত্তার একটা গাণিতিক প্রতীক তিনি ব্যবহার করেছেন। দল্যুজের এ ব্যাখ্যা হচ্ছে ভার্চুয়াল, যা কোনোভাবেই অতীন্দ্রিয় নয়। তাঁর এই ভার্চুয়ালের ধারণার সাথে ডিফ্রেন্সের ধারণার একটা মিল আছে। যে কোনো সমস্যা নিরসনে ধারণার পার্থক্যগুলো আলামতে আনতে হবে, কেননা মনে রাখতে হবে, “difference is related to difference through difference itself”।
খ. নন্দনতত্ত্ব (সংবেদন তত্ত্ব) দল্যুজের নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা তাঁর প্রিন্সিপ্যাল অব ডিফ্রেন্সের ওপর কীভাবে প্রায়োগিক হয়ে উঠবে? কান্ট তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক ধারণাকে দু’টো ভাগে ভাগ করেছেন, একটা ট্রান্সেন্ডেন্টাল এসথেটিক্স বা পারমার্থিক নন্দনতত্ত্ব, অন্যটা ক্রিটিক অব এসথেটিক জাজমেন্ট। দল্যুজ এই দুটো ভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করেছেন। “if the most general aim of art is to “produce a sensation,” then the genetic principles of sensation are at the same time the principles of composition for works of art; conversely, it is works of art that are best capable of revealing these conditions of sensibility”।
গ. নীতিবিদ্যা (প্রভাব তত্ত্ব) দল্যুজ সম্পূর্ণ অন্তর্নির্মিত একটা নীতিবোধের প্রস্তাব করেনঃ ধার্মিকতা মুক্ত নীতিবিদ্যা। এজন্য অশুভতার পরিবর্তে মন্দ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ গুড এভিলের পরিবর্তে গুড ব্যাড। যদি ধরি কোনো নৈতিক ভাবনার পেছনে একটা পারমার্থিক উদ্দেশ্য থাকে যেমনটি কান্ট ভেবেছেন, তাহলে ওই কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করতে হবে আমাদের কাজের বা কাজের উদ্দেশ্যের ওপর। কিন্তু প্রশ্ন আসবে, ওই কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? এর প্রেক্ষিতে দল্যুজের অবস্থান স্পিনজা ও নিটসের মাঝামাঝি। এঁরা দুজনেই নিজেদের অবস্থান থেকে যুক্তি দেখিয়েছেন, এমন কিছু জিনিস আছে যা মানুষ চেতনার ভিত্তি বা দাসত্বের শর্ত ছাড়া কিছু করতে বা ভাবতে পারে না। যেমন একদিকে নিটসে অন্যদিকে স্পিনজা। দল্যুজ মনে করেন, নৈতিকতার অবস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে তার বাস্তব প্রয়োগের বা প্রভাবের ওপর।
ঘ. রাজনীতি (সমাজ-রাজনৈতিক তত্ত্ব)নীতিবিদ্যা ও রাজনীতিকে দল্যুজ ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় একটা বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যে ভিন্নতা সৃষ্টি হলে। কাজেই এটা কোন স্বতঃস্ফূর্ত কিছু নয়।
ঙ. বিশ্লেষণ (ধারণা তত্ত্ব) পরিশেষে তিনি তাঁর ধারণা তত্ত্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন What is Philosophy? গ্রন্থে। আমরা এই পর্বের শুরুতেই তাঁর ধারণা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। এখানে তিনি ধারণার তিন প্রকারের উপাদানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
i) Endo-consistencyএকটা ধারণার মধ্যে থাকে অসংখ্য ভাবনার সমন্বয়। এই বিচিত্র ভাবনার একটা নিবিড় সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে একটা ধারণা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। যেমন, কার্তেসীয় Cogito-র মধ্যে তিনটি উপাদান আছে। সন্দেহ, চিন্তা ও অস্তিত্ব। এবং এদের প্রতিটির মধ্যে আবার আছে সুনির্দিষ্ট পর্বঃ প্রত্যক্ষিত, বৈজ্ঞানিক, এবং আবেশী সন্দেহ। এদেরও আছে আবার কাছাকাছি কিছু সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন, যে সন্দেহ করছে অর্থাৎ এখানে আমি ইত্যাদি।
ii) Exo-consistency একটা ধারণার আবার বহির্মুখীনতা ও অন্তর্মুখীনতা আছে। বহির্মুখীনতার ক্ষেত্রে একটা ধারণা অন্য একটা ধারণার সাথে সংযুক্ত হয়। আবার অন্তর্মুখীনতার ক্ষেত্রে নিজেই অন্য একটা ধারণা সৃষ্টি করে। যেমন দেকার্তের ক্ষেত্রে অসীমের ধারণার সাথে যুক্ত হয়েছে ঈশ্বরের ধারণা। সাথে ঈশ্বরের ধারণার সাথে যুক্ত হয়েছে তার প্রমাণের ধারণা।
iii) Self-referentialityযেমন ধরুন কান্ট দেকার্তের Cogito-র সমালোচনা করে নতুন এক ধারণা সংযুক্ত করলেন সময়ের। অর্থাৎ এক ধারণা সমালচনা করে জন্ম দিলেন অন্য একটা ধারণার। এটাকেই দল্যুজ Self-referentiality হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নম্যাডিজম নম্যাডিজমকে বাংলায় যাযাবরতত্ত্ব বলা যেতে পারে। যাযাবর হচ্ছে পরিবর্তনের এক অমোঘ ও অবধারিত প্রতীক। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, রালফ হডসনের বিখ্যাত “টাইম ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান” কবিতার কথা। সময়কে বৃদ্ধ যাযাবরের সাথে তুলনা করে হাডসন বলেছেন, “Put up your caravan Just for one day?” ১৯১০ সালে লেখা ইংরেজ কবি হাডসনের কী এক আকুতি! আসলে সময়কে এক জায়গায় স্থির করে রাখা তো সম্ভব নয়। জিল দল্যুজ ঠিক এ ধরনের চিন্তার বহমানতাকে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বস্তবতায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে তাঁর ছিল সীমাহীন অবজ্ঞা। ইউরোপে রাষ্ট্রকে দেবতার আসনে বসানোর যাবতীয় কুকর্মের দায়ভার অ্যারিস্টটলের। তিনি নিজেও দাস প্রথাকে সমর্থন জুগিয়েছেন।
যাযাবর শেকড়হীন, ঠিকানা ছাড়া উদ্বাস্তু। কিন্তু রাষ্ট্রীয় চিন্তা অন্তর্জাগতিক। অর্থাৎ Nomadic = exteriority; রাষ্ট্রীয় চিন্তা = interiority। উত্তর-আধুনিক চিন্তার সব দার্শনিক যেমন, দেরিদা, ব্রডিয়ার, লিয়োতার কিংবা ফুঁকো সবাই রাষ্ট্রীয় দর্শনকে বাতিল করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় দর্শন মানেই তাঁদের মতে ভাড়াটে দর্শন। হেগেল যেমন ছিলেন প্রাশিয়ান সরকারের বেতনভুক ও গৃহপালিত দার্শনিক। অন্তর্জগত ও বহির্জগতের যে দ্বন্দ্ব সেটা একত্বের বিরুদ্ধে বহুত্বের অবস্থান। বহুত্বের মাঝে আছে অসমসত্ত্ব, শৃঙ্খলাহীন, বহুমুখী, অসঙ্গত ও বৈচিত্রময়তা। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় দর্শনকে বলা হয় রিপ্রেজেন্টেশন। রিপ্রেজেন্টেশনে বিষয়, কনসেপ্ট, এবং সত্তার মাঝে বিভেদ আছে। জীবনের প্রবাহমানতার জন্য এসব শব্দ প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন অর্থ ধারণ করে। বদলে যায় এর অর্থ। যেমন ধরুন, একটা শব্দ ‘কাটা’। “ফলগুলো কেটে আনো”, “সাঁতার কাটার সময় সাবধান হও”, “আপনার দিন কীভাবে কাটে?”, “লজ্জায় মাথা কেটে গেলো”। এখানে কাটার প্রত্যকেটা অর্থ আলাদা। চলমান জীবন স্রোতে একেক সময় একেক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে Nomadic Space। Nomadic Space আমাদের চিন্তার হেটারজেনেইটি বা অসমসত্ত্বকে জাগিয়ে তোলে। Sedentary বা রাষ্ট্রের অন্দরমহলের দর্শনের সাথে বাইরের তাই এত পার্থক্য। চৌদ্দ শতকের তিউনিশ্যান ইসলামিক দার্শনিক ইবনে খালদুনের Muqaddimah গ্রন্থে মানুষ, সভ্যতা, ইতিহাস সমীক্ষাকে চক্রাকার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। খালদুনের মতে সভ্যতা Sedentary। খালদুনই সম্ভবত ইতিহাসে প্রথম দার্শনিক, যিনি ইতিহাসের মধ্যে একটা বিশেষ ধারা লক্ষ্য করেন এবং সেটা সাইক্লিক্যাল বা চক্রক। জিল দল্যুজ ইবনে খালদুনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
সহস্র মালভূমির কথা বলেন দল্যুজ। বলেছেন Rhizome-এর কথা। মাটির তলে বেড়ে ওঠা উদ্ভিদের যেমন সহস্র মূল প্রসারিত হয়; তেমনই সেটা নম্যাডিক বা যাযাবরির অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাইজমের বিপরীতে এখানে পুঁজিবাদ সমাজ বাস্তবতা।
উপসংহারজিল দল্যুজ সন্দেহাতীতভাবে একুশ শতকের সমাজ ও দর্শন ভাবনায় এক অনন্য নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গোটা বিশ্বে যে হলিজম বা বহুত্ববাদের প্রসার ঘটে; জিল দল্যুজের অবদান তার মধ্যে অন্যতম। কান্ট, হেগেলের দর্শনের ভয়াবহতার বিপরীতে দল্যুজ একটা নতুন ধারা তৈরি করতে চেয়েছেন। তবে তাঁর বাচনিক দুর্বোধ্যতার কারণে অনেকেই মূল বিষয় থেকে দূরে। প্রকাশের অস্পষ্টতা তাঁকে আরও দুর্বোধ্য করেছে। প্রাচীন গ্রীক দর্শন থেকে শুরু হওয়া বহুত্ববাদের যে স্রোত তা দল্যুজের কাছে এসে পূর্ণ হয়। তাঁর ভিন্নতার দর্শনের (Philosophy of Difference) তাৎপর্য এখানেই যে তিনি একক ও সর্বজনীন চিন্তার শেকড় উৎপাটন করেছেন। এবং যথার্থই বলেছেন, “only a principle of difference is capable of providing a rigorous response to the question of heterogenies: “What are the conditions for the production of the new?” (artistic creation, conceptual innovation, social change”.
>> আগের পর্ব পড়ুন- জিল দল্যুজ: দুর্বোধ্যতার আড়ালে অনন্য যাযাবর
এসইউ/এমএস