১০ বছর আগেও লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা আর খাসির চামড়া ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এতে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে লাভবান হতেন বিক্রেতারা। কিন্তু দশ বছরের ব্যবধানে তলানিতে ঠেকেছে চামড়ার দাম। এবার ঈদের আগে সরকার চামড়ার দর নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। রংপুরে পানির দরে বিক্রি হয়েছে গরুর চামড়া। অনেক ক্ষেত্রে ফ্রি-তে দেওয়া হয়েছে ছাগলের চামড়া।
Advertisement
মঙ্গলবার (৪ জুলাই) বিকেলে নগরীর শাপলা চত্বর চামড়াপট্টিতে গিয়ে দেখা যায় অনেকটাই সুনসান নীরবতা। বছর দশেক আগেও যে হাঁকডাক ছিল এই এলাকায় এখন তার কিছুই নেই। হাতেগোনা তিন-চারজন এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন।
নগরীর মুলাটোল পাকারমাথা এলাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ৮০ হাজার টাকা টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলাম। সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী চামড়ার বাজারমূল্য হয় হাজার টাকা। কিন্তু সেটা ২০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে।
কামাল কাছনা এলাকার সেলিম মিয়া বলেন, দেড় লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে ১২০০ টাকার চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ৪০০ টাকায়। বছর দশেক আগেও প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম গড়ে ১৫০০ টাকা থাকলেও গত দুই-তিন বছর ধরে এটি গড়ে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে।
Advertisement
উত্তম হাজিরহাট এলাকার আব্দুস সালাম বলেন, গরুর চামড়ার দাম দেড়শ টাকা বলেছিল এক মৌসুমী ব্যবসায়ী। তাই বিক্রি না করে মাদ্রাসায় দান করে দিয়েছি।
সরকার কোরবানির পশুর চামড়া প্রতি বর্গফুট হিসাবে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই হিসাবে এবার গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা হলেও ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৪৮ টাকা। কিন্তু রংপুর নগরসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যবসায়ীরা কৌশলে ১৫-২৫ টাকা প্রতি বর্গফুটে দাম দিচ্ছেন।
নজিরের হাট এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ী সোলেমান মিয়া বলেন, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ২০ পিস গরুর চামড়া কিনেছি। কয়েকদিন বাড়িতে রেখে আজ চামড়াপট্টিতে এনেছি কিছু লাভের আশায়। কিন্তু এখানেও সেই আশানুরূপ দাম পাওয়া যাবে না। পাইকারি মহাজনরা যে দাম বলছেন তাতে আসলটা কোনো রকমে উঠবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, প্রয়োজনীয় মূলধন না থাকা এবং ট্যানারি মালিকদের কাছে টাকা বকেয়া থাকাসহ নানা কারণে অনেক ব্যবসায়ী এ পেশা থেকে সরে আসছেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। তাদের কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিক্রেতা ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়ার জন্য প্রসিদ্ধ রংপুরের চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। চামড়ার দাম কম দিতে নানা অযুহাতের ফাঁদগল্প শুনতে হয়েছে তাদের। সঙ্গে এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট ও খারাপ আচরণের কারণে বাইরের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এর প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে।
তবে চামড়া ব্যবসায়ীদের দাবি, সিন্ডিকেট মফস্বল পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপ-দাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন, তারা হাতে গোনা কয়েকজন।
চামড়া বিমুখ হয়ে পড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের পথে বসিয়ে দিয়েছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। করোনা শুরুর আগের বছর থেকে ঢাকার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনে ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করেননি। ফলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও সব পুঁজি রয়ে গেছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। বছরের পর বছর বকেয়া টাকা তুলতে না পেরে অনেকে আবার বাপ-দাদার আদি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল লতিফ খান জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা ঈদে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে চামড়া কেনেন। ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা চামড়া ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন। একদিকে পুঁজি সংকট অপরদিকে লবণের দাম বাড়ায় এবারও চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
আব্দুল লতিফ খান আরও বলেন, চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিত ট্যানারির মধ্যে এখন মাত্র ১৫ থেকে ২০টি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাচ্ছেন না।
ভালো দাম না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বর্তমানে সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউই ভালো দাম পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ফলে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
এফএ/এএসএম