দেশজুড়ে

সুযোগের অপেক্ষায় চামড়া চোরাচালানীরা

প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে তৎপর হয়ে ওঠে চোরাচালানীরা। দেশে চামড়ার দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় তা পাচারের চেষ্টা হয় ভারতে। দেশে এবারও কোরবানির চামড়া পানির দরে বিক্রি হওয়ায় ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে উত্তরের সীমান্ত দিয়ে কোরবানির চামড়া পাচার ঠেকাতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করেছে বিজিবি।

Advertisement

জানা গেছে, চামড়াবোঝাই কোনো ট্রাক সীমান্ত অভিমুখে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া চামড়া চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত মৌসুমী ব্যবসায়িদের তালিকা করে তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ এই সতর্কতা থাকবে বলে জনিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভারতীয় সীমান্ত এলাকা বালুঘাট, মালদা, কুচবিহারে গরুর একটি কাঁচা চামড়ার দাম দুই হাজার থেকে ২৫০০ রুপি। আর দেশে ছাগলের চামড়ার কোনো চাহিদা না থাকলেও ভারতে একটি চামড়া বিক্রি হয় ৩০০-৪০০ রুপিতে।

আরও পড়ুন: কম দামে অর্ধেক চামড়া নিয়ে যাচ্ছে চীন

Advertisement

পাঁচবিবি উচনা সীমান্ত এলাকার মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, চোরাকারবারিরা প্রতি বছর কোরবানির চামড়া ভারতে পাচারের চেষ্টা করে। কারণ ভারতে চামড়ার মূল্য তুলনামূলক অনেক বেশি। দেশে চামড়ার মূল্য অনেক কম। ফলে হাড়িপুকুর, রায়ভাগ, মংলা, নন্দিপুর, ডাঙ্গাপাড়া ও ঘাসুড়িয়া পয়েন্ট ছাড়াও দিনাজপুরের বিরামপুর ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্তের পয়েন্টগুলো দিয়ে ভারতে চামড়া পাচারের চেষ্টা হয়। তবে যে চামড়া পাচার করা হয় সেটি সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে নেওয়া হয়।কারণ শুকালে চামড়ার ওজন কমে যায়, সহজে বহনযোগ্য হয়।

তিনি আরও বলেন, কোরবানির পরপরই আইনশৃংখলা বাহিনী ও সীমান্তরক্ষীরা বেশ তৎপর থাকলেও দুই সপ্তাহ পর থেকে কিছুটা ঢিলেঢালা হয়ে যায়। তখনই সুযোগ কাজে লাগায় চোরাকারবারিরা।

ঈদের দুইদিন আগে পাঁচবিবি চেঁচড়া সীমান্তের বিপরীত পাশে ভারতের উচনা সীমান্তের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে চোরাকারবারির মূলরুট নিয়ন্ত্রণ করেন জুয়েল, মাহাতাব, হিরো ও জিয়া নামের কয়েকজন। তাদের সিগন্যালে উচনা সীমান্ত দিয়ে ভারতের ঘুনাপাড়া ও ঘোসাইপুর গ্রাম থেকে বাংলাদেশে মালামাল আসে-যায়। এখানে ভারতের অসংখ্য সীমানা নির্ধারণী খুঁটি দেখা গেলেও বিজিবি কিংবা বিএসএফ সদস্যদের তৎপরতা অনেক থাকে বলে জানা যায়। সামনে বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে যখন তখন ভারতে যাওয়া-আসা করতে কোনো বাধা পেতে হয় না।

আরও পড়ুন: বর্ডার দিয়ে কেউ চামড়া নিয়ে আসতে-যেতে পারবে না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

Advertisement

এই একই পথে আরও ৫ কিলোমিটার সামনে কল্যাণপুর সীমান্ত। ভারতের শ্রীপুর গ্রাম সেখানে। এই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করেন শাহিন নামের একজন। মূলত এরাই চোরাইপথে মাদক ও চামড়া পাচারের সঙ্গে জড়িত।

দিল্লির একটি ট্যানারি ফ্যাক্টরির সহকারী ম্যানেজার তারেক হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে সেখানে গরু ও ছাগলের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর বাংলাদেশি চামড়া সবসময়ই তাদের পছন্দের শীর্ষে। তবে বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানির সুযোগ না থাকায় তারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে গরুর চামড়া আমদানি করে।

তিনি স্বীকার করেন যে, প্রতিবছর কোরবানির পর কিছু চামড়া চোরাকারবারির মাধ্যমে ভারতে আসে। এখানে দামের বড় রকমের গ্যাপ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করে একটি চক্র।

জানা গেছে, দিনাজপুরের হিলিসহ জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি সীমান্ত এলাকা প্রায় ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এরমধ্যে ২৩ কিলোমিটার জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও ১৮ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে উন্মুক্ত। তাই এবার এসব এলাকাকে নজরদারিতে রেখেছে বিজিবি। সীমান্তে নিয়মিত প্রহরার পাশাপাশি বাড়তি সদস্য মোতায়েন করে টহল ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।

চামড়া পাচার রোধে নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়ে বিজিবি জয়পুরহাটের-২০ (বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রণাধীন জয়পুরহাট, পাঁচবিবি ও হিলি সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও অরক্ষিত এলাকাসহ সীমান্তজুড়ে বিশেষ সর্তকতা নেওয়া হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় গরু এ পথে আসতে দেওয়া হয়নি। একইভাবে চামড়া যাতে কোনোভাবে পাচার না হতে পারে, সেজন্য বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সতর্কতা হিসেবে ২৪ ঘণ্টা কড়া নজরদারি ও পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানায়, সীমান্তের অনেক আড়তের মালিকের সঙ্গে ভারতের ট্যানারি মালিক প্রতিনিধিদের আগাম চুক্তি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে অনেক ব্যবসায়ী আগাম টাকা নিয়েছেন। তবে অতিগোপনে এই কাজ করায় সেটি প্রকাশ্যে আসে কম।

হিলি সিপি রোডের চামড়া ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেনের ছেলে রুবেল হোসেন জানান, একটি চক্র সিন্ডিকেট করে কোরবানির মৌসুমে কম দামে চামড়া কেনে। এরা গ্রামের ভেতরে ঢুকে চামড়া সংগ্রহ করে। এই চামড়া অনেক সময় তাদের কাছে এনে বিক্রি করে, আবার কোনো কোনো সময় সেগুলো কাছে আনা হয় না। নিজেরাই লবণ লাগিয়ে সংরক্ষণ করে থাকে। এই চামড়া পরে কোথায় যায় সেটিই একটা রহস্য।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের চামড়ার আড়ত, এখনো শতকোটি বাকি ব্যবসায়ীদের

রুবেল জানান, এবার দেশে চামড়ার বাজার খুব খারাপ। এর ওপর যোগ হয়েছে অতিরিক্ত শ্রমিক খরচ ও লবণের দাম। গরুর একটি চামড়া সংরক্ষণের জন্য সব মিলিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ পড়ে যায়। এরপর সেটি হাটে বিক্রির জন্য নিলে অতিরিক্ত আরও ১০০ টাকা যোগ হয়ে যাবে। এতকিছুর পর বাজারদর সঠিক না পেলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যান ব্যবসায়ীরা। যার কারণে প্রতিবছর এই ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ছেন অনেকে।

বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র জানায়, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ছাড়াও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, নাগেশ্বরী, বড়াইবাড়ি, লালমনিরহাটের মোগলহাট, পাটগ্রাম, বড়খাতা, নীলফামারীর ডোমার, চিলাহাটি, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া, রাজশাহীর গোদাগাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাটসসহ পুরো সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতা চলছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে কোরবানির চামড়া পাচার রোধে বিজিবি জওয়ানদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে চামড়া পাচারে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজনদের ওপর নেওয়া হয়েছে নজরদারী। ঈদ পরবর্তী ১৫ দিন পর্যন্ত এই নজরদারী বলবৎ থাকবে।

এফএ/এএইচ/জিকেএস