অবশেষে বহুল প্রত্যাশিত এসপিএম (ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন) প্রকল্পে ক্রুড অয়েলের ‘ফার্স্ট ফিলিং’ শুরু হয়েছে। সোমবার (৩ জুলাই) সকাল সোয়া ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালীতে স্থাপিত ভাসমান এসপিএম-এ ক্রুড অয়েল খালাসের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়।
Advertisement
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান।
তিনি বলেন, সোমবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে জাহাজ থেকে এসপিএমে প্রথমবার ফিলিং শুরু হয়। জাহাজ থেকে খালাস নেওয়া এসব ক্রুড অয়েল মহেশখালীর কালারমারছড়া এলাকায় স্থাপিত শোর ট্যাংকে নেওয়া হচ্ছে। এরপর এসব ক্রুড অয়েল পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার কমিশনিং ও টেস্টিং সম্পন্ন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে এসপিএমের মাধ্যমে খালাস নেওয়া এসব ক্রুড অয়েল কালারমারছড়া শোর ট্যাংক থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আনার ক্ষেত্রে কিছু সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
Advertisement
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী পাইপলাইনে তেল সরবরাহ কার্যক্রম উদ্বোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিডিউল নির্ধারণ করা গেলে পাইপলাইনের মাধ্যমে এসব ক্রুড অয়েল পতেঙ্গায় নিয়ে আসা হবে।
আরও পড়ুন: ২৮-৪৮ ঘণ্টায় খালাস হবে ডিজেল ও ক্রুড অয়েল
এদিকে গত ২৫ জুন এই কার্যক্রমের সূচি নির্ধারিত থাকলেও সাগর উত্তাল থাকার কারণে প্রাথমিক অপারেশন কার্যক্রম পেছাতে হয়। এর আগে সৌদি আরব থেকে ৮১ হাজার ৭৩৫ টন এরাবিয়ান ক্রুড অয়েল নিয়ে ট্যাংকার ভ্যাসেল ‘এমটি হোরে’ গত ২৪ জুন মহেশখালীতে এসপিএম সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে লাইটারেজে করে খালাস করতে যে জাহাজে সময় লাগতো ১১ দিনের বেশি, সেখানে এখন ২৮-৪৮ ঘণ্টা লাগবে। সর্বোচ্চা এক লাখ ২০ হাজার টনের জাহাজ খালাস হতে সময় লাগবে ৪৮ ঘণ্টা।
Advertisement
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বর্তমানে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন। নির্মাণাধীন ইউনিট-২ চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিকটন ডিজেল আমদানি করতে হয়। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা ৮ মিটার থেকে ১৪ মিটারের নীচে হওয়াতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভ্যাসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। এ কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার (বড়) ভ্যাসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা হয়। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজে করে ক্রুড আনলোড করা হয়। লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ক্রুড আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। আমদানি করা জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে এসপিএমসহ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
২০১০ সালে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিপিসি। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে সময়ক্ষেপণে প্রকল্পটির ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কয়েকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকায় প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। প্রশাসনিক অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসিএল)-এর সাথে চুক্তি করে বিপিসি। প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। এরপর প্রায় তিন দফায় সংশোধিত হয়ে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকায়। বর্তমানে আরও ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা ব্যয় এবং এক বছর সময় বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এতে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। নতুন প্রস্তাবনা অনুসারে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ৩০ জুন সম্পন্ন হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালীর মাতারবাড়ি উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মহেশখালীতে পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে অফ-শোরে ১৪৬ কিলোমিটার ও অনশোরে ৭৪ কিলোমিটারসহ মোট ২২০ কিলোটিমার পাইপলাইন স্থাপনের কাজও শেষ হয়েছে।
অন্যদিকে কুতুবদিয়া চ্যানেল এবং মাতারবাড়ি অ্যাপ্রোচ চ্যানেল অংশে ডিপ পোস্ট ট্রেন্সিং পদ্ধতিতে চারটি পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরতায় স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মহেশখালীর ধলঘাটায় একটি, চট্টগ্রামের গহিরায় একটি, ডাঙ্গারচরে একটি ব্লক বাল্ব স্টেশন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মাইক্রোয়েভ রিলে টাওয়ারের কাজও শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শরীফ হাসনাত জাগো নিউজকে বলেন, সোমবার সকালে এসপিএমে ফার্স্ট ফিলিং শুরু হয়েছে। জাহাজ থেকে খালাস নেওয়া তেল ট্যাংকে নেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে কমিশনিং ও যান্ত্রিক পরীক্ষার জন্য কম-বেশি করে জ্বালানি খালাস নেওয়া হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বুধবার সকালের দিকে জাহাজটি থেকে ক্রুড অয়েল খালাস শেষ হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে তার আগেও খালাস সম্পন্ন হতে পারে।
ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/এএসএম