মতামত

জনগণ বেছে নিক সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটি- ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা। বাংলাদেশে আমরা সহজ করে বলি, রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই উৎসব। তবে রাজনীতিবিদদের জন্য ঈদ মানেই শঙ্কা। যারা ভোটের রাজনীতি করেন, তাদের সবাইকে খুশি করে ঈদ উদযাপন করতে হয়, যা তাদের জন্য যথেষ্ট চাপের। বিশেষ করে ঈদুল আজহা, মানে কোরবানির ঈদে রাজনীতিবিদদের অনেক বেশি পশু কোরবানি দিতে হয়। মাংস পৌঁছে দিতে হয় নেতাকর্মী, ভোটারদের ঘরে ঘরে। আগামী নির্বাচনের আগে সর্বশেষ ঈদুল আজহা ছিল এটি। তাই এবার রাজনীতিবিদরা একটু বেশিই সময় দিয়েছেন এলাকায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় যাচ্ছেন, জনগণকে সময় দিচ্ছেন; এটা আনন্দের সংবাদ।

Advertisement

অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। জনগণও এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের ভূমিকা ছিল সামান্যই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশই নেয়নি। সে নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। একতরফা নির্বাচনে বাকিরাও পেয়েছিলেন অনায়াস জয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে নামকাওয়াস্তে অংশ নিলেও জেতার কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না। বিএনপির নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পুলিশ ও আমলারা মিলে দৃষ্টিকটুরকমের বাজে নির্বাচনের উদাহরণ গড়ে। সে নির্বাচনেও জনগণের ভূমিকা ছিল সামান্যই।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবার ধারণা ছিল দলের মনোনয়ন পাওয়াটাই আসল। মনোনয়ন পেলে জয় আসবেই। জাতীয় নির্বাচন থেকে এ ধারণা ছড়ায় স্থানীয় নির্বাচনেও। ভোটাররাও যখন বুঝে যান, প্রতিনিধি নির্বাচনে তাদের ভূমিকা গৌণ, তখন তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ছেড়ে দেন। জাতীয় বা স্থানীয় সব নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে তাই ভোটারদের দেখা পাওয়াই ছিল দুষ্কর। অনেকদিন পর এ ধারায় পরিবর্তন এসেছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই হোক, ভোটাররা আবার কেন্দ্রে ফিরেছেন, গণতন্ত্রের জন্য এটা বড় সুখবর। অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ নেতারা জেনে আসছেন, যে কোনোভাবে শেখ হাসিনা তাদের জিতিয়ে আনবেন। তাদের কিছুই করতে হবে না। তবে শেখ হাসিনা বছরখানেক ধরে দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারবার বলছেন, আগামী নির্বাচন সহজ হবে না।

Advertisement

নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তিনি দলীয় প্রার্থীদের সরকারের উন্নয়ন কাজ নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কথা দলের নেতাকর্মীরা সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে মনে হয়নি এতদিন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির পর হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে দেশের নির্বাচনী আবহ। সরকারি দলের নেতারাও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তবে পরপর দুটি একতরফা নির্বাচনে জিতে আসা আওয়ামী লীগ নেতারা এরইমধ্যে যথেষ্ট জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

ভোটে জিততে ভোটার লাগে না, এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়ায়, তারা আর জনগণের কাছে যাননি। যান তো নাই, উল্টো নানা জনবিরোধী কাজ করে নিজেদের আরও দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়ন করেছেন; আর স্থানীয় নেতারা মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে দলকে বিচ্ছিন্ন করেছেন।

তাই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আগের মতো অটো হবে না, এটা এবার নিশ্চিত। যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জিততে পারবেন, জনগণের সাথে যাদের যোগাযোগ নিবিড়, তারাই পাবেন এবার মনোনয়ন। এবার লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। একবার দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে, আরেকবার নির্বাচনের চূড়ান্ত লড়াইয়ে। মনোনয়নের ব্যাপারে শেখ হাসিনা কতটা কঠোর হবেন, তার ছোট্ট একটা নমুনা সবাই দেখেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনে।

অনেকদিন ধরেই বরিশালের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাই এবং ১৫ আগস্ট প্রাণে বেঁচে যাওয়া আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তার ছেলে সাদেক আব্দুল্লাহ। কিন্তু সাদেক আব্দুল্লাহর পাঁচ বছরের শাসনামল ছিল দুঃশাসনের। বরিশালবাসী ধরেই নিয়েছিলেন, সাদেক আব্দুল্লাহই আবার মনোনয়ন পাবেন এবং মেয়র হবেন; এটাই তাদের নিয়তি। কিন্তু শেখ হাসিনার মনে ছিল ভিন্ন ভাবনা।

Advertisement

আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ মনোনয়ন বোর্ডে অসুস্থতার ভাণ করেও ছেলের মনোনয়ন ধরে রাখতে পারেননি। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় সাদেক আব্দুল্লাহর চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে। অপকর্ম করে ঘরের মানুষও যেখানে পার পায়নি, সেখানে আগামী নির্বাচনে জনবিচ্ছিন্ন নেতারা যে মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

আওয়ামী লীগের মূল সমস্যা হলো অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রতিটি আসনেই একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী আছেন। কোথাও কোথাও দলীয় কোন্দল এতটাই তীব্র, আওয়ামী লীগকে হারাতে আওয়ামী লীগই জান দিয়ে মাঠে নামে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হেরেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। শুধু গাজীপুর নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীরাই ছিল আওয়াম লীগের জন্য মাথাব্যথা। দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েও তাদের নিবৃত করা যায়নি।

আগামী নির্বাচনের জন্য প্রতিটি আসনে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা তো মনোনয়ন দৌড়ে আছেনই; আছেন ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলারাও। একজন মনোনয়ন পেলে বাকি সবাই যদি সব ভুলে তার পক্ষে থাকেন, তাহলে কাজটা সহজ হয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ঘটনা। মনোনয়নবঞ্চিত সবাই মিলে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যক্তির পরাজয় নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লাগেন। কোন্দল মেটাতে না পারলে আগামী নির্বাচন সত্যি কঠিন হবে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী নির্বাচনে কারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, প্রার্থী হতে ইচ্ছুক এমন অনেকের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নেওয়া হবে। নির্বাচনে প্রার্থীর বিষয়ে আমরা শত ফুল ফুটতে দেওয়ার পক্ষে। শত ফুল ফুটতে দিন, যে ফুলটি সব থেকে সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব।

শেখ হাসিনার ধারণাটি চমৎকার এবং গণতান্ত্রিক। শত ফুল ফুটবে। তিনি সেখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি বেছে নেবেন। আর আমাদের প্রত্যাশা হলো, জনগণ বেছে নেবে সব দলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম