সাহিত্য

জিল দল্যুজ: দুর্বোধ্যতার আড়ালে অনন্য যাযাবর

জিল লুইস রেনে দল্যুজ (১৯২৫-১৯৯৫) বিশ শতকের সবচেয়ে আলোকিত ও আলোচিত ফরাসি দার্শনিক। উত্তর-আধুনিক দার্শনিক চিন্তায় তাঁর অবস্থান ও অবদান নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুঁকো ১৯৭৮ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “আমি মনে করি বিংশ শতাব্দির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দার্শনিক তিনি, সম্ভবত একদিন মানুষ এই শতাব্দিকে দলুজ্যিয়ান শতাব্দি হিসেবে পরিচয় দেবে”। জিল দল্যুজ সম্পর্কে তারই বন্ধু ফুঁকো যখন এভাবে পরিচয় করিয়ে দেন; তখন তাঁর চিন্তার উৎকর্ষতা নিয়ে আমাদের কোনো কিছু ভাবার দরকার পড়ে না। কারণ মিশেল ফুঁকোও ছিলেন কালোত্তীর্ণ মানুষ, যার মনঃসমাজ- বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাদের চিন্তা জগতকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে চলেছে। আমরা জানি, ফুঁকো জ্ঞান ও ক্ষমতাকে একে অন্যের পরিপূরক বলে মনে করেন। একটাকে ছাড়া অন্যটাকে পৃথক করা অসম্ভব। ফুঁকো সাম্প্রতিক দর্শন চিন্তায় সমাজ, রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও নৈতিকতার ওপর সাংঘাতিক প্রভাব রেখেছেন।

Advertisement

তবে জিল দল্যুজ শুধু দর্শনই নয় সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, চিকিৎসা, শিল্পকলা, ফিল্ম ও চিত্রকলার গূঢ় অনুষঙ্গের ভেতরও চিন্তার ছাপ রেখেছেন অমলিনভাবে। তবে তাঁর ওপর অনেকেই যারা ভাষ্যরচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে Daniel W. Smith অন্যতম; স্মিথ মনে করেন, তাঁকে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনো এক বিশেষ ঘরানার মানুষ হিসেবে আখ্যা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ তাঁর ওপর সমকালীন ফরাসি দর্শনের কোনো বিশেষ ধারা আরোপ করতে গেলে অসুবিধায় পড়তে হবে বৈ কি! কারণ তিনি ছিলেন না কোনো কাঠামোবাদী, ছিলেন না রূপবিজ্ঞানী, ছিলেন না হাইডেগারিয়ান, এমনকি পোস্ট-মর্ডানিস্টও। দেরিদা, লিওটার্ড কিংবা লেভিনেস প্রমুখ দার্শনিকরা যেখানে শুরু করেছেন হুসার্ল দিয়ে দল্যুজ সেখানে করেছেন হিউমকে নিয়ে। তবে তাঁর সব লেখারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে, যাকে আমরা বলতে পারি এক্লেক্টিসিজম বা বহুত্ববাদ। এ কারণেই তাঁকে উত্তর-আধুনিক হিসেবে না মেনে উপায় নেই। আরেক ফরাসি সাহিত্যিক, লেখক ও দার্শনিক মিসেল সেরেস (Michel Serres) মনে করেন, সৃজনশীল ও মুক্ত চিন্তার অন্যতম প্রতীক দল্যুজ সত্যিকার অর্থে দর্শন তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, দিয়েছে অনাবিল আনন্দ।

দল্যুজ মনে করতেন দর্শন হচ্ছে কনসেপ্ট বা ধারণার ফসল। আর এ ধারণা কোনো সময়ই অবিমিশ্র বা ঋজু নয়। একটা ধারণা অন্যের সাথে ভীষণভাবে যুক্ত। পৃথিবীতে এমন কোনো ধারণা নেই, যার একটামাত্র সাংগঠনিক উপাদান আছে। অর্থাৎ প্রতিটা ধারণাই একাধিক উপাদানের সাথে সংযুক্ত। আসলে দর্শন হচ্ছে, “the art of forming, inventing, and fabricating concepts”। যেটাকে আমরা বহুত্ববাদ বলছি দল্যুজ সেটাকে অভিজ্ঞতাবাদ বলছেন। অভিজ্ঞতা যেমনি নানা রঙে রঙিন এবং কোনো বিমূর্ত ধারণার বিপরীতে বস্তুগত চেতনার ফল্গুধারা তেমনি দর্শনও তাই। ঐক্যের ভেতর অনৈক্য, মিলের ভেতর বিরোধ, আর সমতার মাঝে অসাম্যই হচ্ছে দল্যুজের দার্শনিক ভাবনার মূলসূত্র। এটাকে আপেক্ষিকবাদও বলা যেতে পারে।

তাঁর নিজের ভাষ্যমতে, “Even the first concept, the one with which a philosophy ‘‘begins,’’ has several components, because it is not obvious that philosophy must have a beginning, and if it does determine one, it must combine it with a point of view or a ground”। তিনি একজন বিশুদ্ধ অধিবিদ ও অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে পরিচিত হতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অভিজ্ঞতাবাদীদের মূল কাজই যেখানে অধিবিদ্যাকে উড়িয়ে দেওয়া; সেখানে একই সাথে নিজেকে অধিবিদ ও অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা বেশ খানিকটা প্যারাডক্সের মতো শোনায়, নয় কী? একটু প্যারাডক্সের মতো শোনালেও তিনি করতে চেয়েছেন সীমা অসীমের বিপুল সংমিশ্রণ। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি ভেবেছেন, “অরূপ তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।/ তোমায় আমায় মিলন হলে সকলি যায় খুলে—বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে ওঠে তখন দুলে”।

Advertisement

হ্যান্স স্কুমাচার দারুণ এক প্রবন্ধ লিখেছেন Pluralism=Monism: A Study on Deleuzian Dialectics শিরোনামে। দল্যুজকে বরাত দিয়ে স্কুমাচার বলেছেন, বহুত্ববাদ ও একত্ববাদের মধ্যে কোনো পরিমাণগত পার্থক্য নেই। যেমন ধরুন, আপনি বাজারে ২০ কেজি সবজি বিক্রি করতে নিয়ে গেলেন। এই বিশ কেজি হয়তো ১৫ জনের কাছে বিক্রি করলেন। ১৫ জনের কাছে ভেঙে ভেঙে বিক্রি করলেও সামগ্রিক পরিমাণ সেই ২০ কেজিই থাকবে। অর্থাৎ বহুত্ববাদ একত্ববাদের থেকে কমও নয়, বেশিও নয়। আবার একত্ববাদ বহুত্ববাদের থেকে পরিমাণগত ভাবে বেশিও নয়, নয় কমও। তাই এদের গাণিতিক একটা সাযুজ্যতা আছে। যাই হোক, সে কথায় পরে আসছি। তবে প্রচলিত অধিবিদ্যার মতো তিনি আধ্যাত্মবাদকে বেছে না নিয়ে বরং গণিত ও বিজ্ঞানের জন্য একটা অধিবিদ্যা বিকাশের চেষ্টা করেন। এই অধিবিদ্যা বরং বহুত্বের ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করে, প্রতিস্থাপিত করে সত্তার ধারণা কিংবা ভার্চুয়ালিটির সম্ভাবনা। জিল দল্যুজ দর্শনের ইতিহাস নিয়ে এত বেশি বিশ্লেষণ করেছেন, যা সম্ভবত সমসাময়িক দার্শনিকদের মাঝে বিরল। তিনি স্পিনজা, লাইবেনিজ, হিউম, কান্ট, বার্গঁস, নিটসের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন। এছাড়া সাহিত্য ও শিল্পকলার ওপরও তাঁর আগ্রহ ছিল সীমাহীন। ১৯৬০-এর দশকের শেষে বিশুদ্ধ মনঃবিশ্লেষক বলে খ্যাত ফেলিক্স গাত্তারির সাথে তিনি অনেক কাজ করেন যৌথভাবে, এর মধ্যে What is Philosophy? অন্যতম। আমরা পরের আলোচনায় এসব বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবো। সবার আগে জিল দল্যুজ নিয়ে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখে নেওয়া যাক।

জিল দল্যুজ প্যারিসের এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের দিকে যখন জার্মানি ফ্রান্স দখল করে; তখন তাঁর পরিবার নরম্যান্ডি গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই স্কুলে ভর্তি হন। দল্যুজের বড় ভাই জর্জ স্কুলে পড়ার সময় দখলদারদের হাতে বন্দি হয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারা যান। দল্যুজ ফ্রান্সের খুব নামকরা মানুষদের সংস্পর্শে আসেন সেসময়। এঁদের মধ্যে পিয়েরে হল্বাউচ অন্যতম। পিয়েরে হল্বাউচ ছিলেন সে সময়ের প্রসিদ্ধ সমাজবিজ্ঞানী মরিচ হল্বাউচের পুত্র। তিনি দল্যুজকে বদলেয়ার ও আন্দ্রে গাইডের সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আন্দ্রে গাইড ১৯৪৭–এ নোবেল পুরস্কার পান। তা ছাড়া শার্ল বদলেয়ারের কথা তো আমরা জানি, যিনি ছিলেন উনিশ শতকের সবচেয়ে আলোকিত ফরাসি রোমান্টিক কবি। এরপর ফ্রান্স মুক্ত হলে দল্যুজ প্যারিসে ফিরে এসে প্যারিসের খুবই নামকরা স্কুল Lycée Henri-IV-এ ভর্তি হন। তিনি শরবনে দর্শনের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন। এখানে তিনি ফরাসি দার্শনিক হিপপলাইট, ফার্ডিন্যান্ড, জর্জ কানিংহাম, মরিচ ডি গ্যান্ডিল্যাক প্রমুখ দার্শনিকের সংস্পর্শে আসেন। তবে ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে জ্যাঁ-পল-সার্তকে তিনি সবচেয়ে উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। নোবেল বিজয়ী সার্ত অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। তাঁর অস্তিত্ববাদ সাহিত্য ও দর্শনে এক বিশেষ মাত্রায় অভিসিক্ত। সার্ত পরবর্তী ফরাসি দার্শনিক ভাবনায় অনেকেই তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ১৯৬৪ সালে সার্ত নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে দল্যুজ “He was my Teacher” শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।

দল্যুজ শরবনে পড়ার সময় হিউমের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৯৫৩ সালে লেখেন Empiricism and Subjectivity। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ। তখন École Normale Supérieure-এ ফুঁকো ও দেরিদা ব্যস্ত ছিলেন “Three H” নিয়ে। Three H এর অর্থ Hegel, Husserl, Heidegger। তবে আরেকটি H যোগ করলে হয়তো মন্দ ছিল না। কারণ তাঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে হিউমের চিন্তার সাথে যুক্ত ছিলেন। আর জিল দল্যুজ তো সরাসরি হিউমের কাছে চিন্তার অনেক ঋণ স্বীকারই করেছেন। তিনি কেন হিউমের কাছে চিন্তা সমর্পণ করেছেন, তা বোঝা যায় তাঁর নিজের কথায়। Jeffrey A. Bell তাঁর Deleuze’s Hume: Philosophy, Culture and the Scottish Enlightenment গ্রন্থে লিখেছেন, দিল্যুজ মনে করতেন তিনি একজন অভিজ্ঞতাবাদী, যার কারণেই তিনি বহুত্ববাদী। দিল্যুজের অবস্থান অনেকটা উইলিয়াম জেমসের মতো। দল্যুজের জ্ঞান সর্ববিস্তৃত এবং বহুভেদী। Dainel W. Smith তাঁর বহুগামী বিচিত্র চিন্তার যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করেছেন এভাবে, “His writings are not only strongly grounded in the history of philosophy, but are also dotted with references to numerous non-philosophical domains, including differential calculus, thermodynamics, geology, molecular biology, population genetics, ethology, embryology, anthropology, psychoanalysis, economics, linguistics, and even esoteric thought।” ১৯৫৬ সালে ডেনিস ফ্যেনি নামে একজনকে বিয়ে করেন। ফ্যেনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ করে ডি এইচ লরেন্স বিশেষজ্ঞ।

১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিওনে অধ্যাপনা করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে যে সাংঘাতিক আন্দোলন হয় সেটার সাথে দল্যুজ সম্পৃক্ত ছিলেন। পরের বছর ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে তিনি যোগ দেন। ১৯৮৭-তে অবসরের আগ পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৮ সালের দিকে ফেলিক্স গাত্তারির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। গাত্তারির সাথে জীবনের বড় একটা অংশ তিনি যৌথভাবে গবেষণার জন্য ব্যয় করেন। দুজনের যুগলবন্দিতে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

Advertisement

Masochism: Coldness and Cruelty নামে ১৯৬৭ সালে দল্যুজ মানুষের যৌন মনস্তত্ত্বের ওপর একটা অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি মূলত উনিশ শতকের অস্ট্রিয়ান উপন্যাসিক লিওপল্ড ভন সাকের-মাসোখের চিন্তার দার্শনিক পুনঃমুল্যায়ন। আমরা জানি, মানুষের অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের দুটো গভীর প্রত্যয় হচ্ছে, স্যাডিজম বা ধর্ষকাম এবং অন্যটা মেসোসিজম বা মর্ষকাম। এক ধরনের মানুষ আছেন, যারা শারীরিকভাবে নির্যাতন করে আনন্দ পান, অন্যদিকে নির্যাতিত হয়ে আনন্দ পান। এ বাসনা অবশ্যই বিপরীত লৈঙ্গিক পরিচিতির ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। সাকের মাসোখের উপন্যাস Venus in Furs এর বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক।

অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত চিন্তাবিদ মারকুইস ডি সাদের কথা অনেকেই জানেন। তিনি ফরাসি দেশের নামকরা দার্শনিকও বটে! তাঁর শরীরে বাসা বাঁধা অস্বাভাবিক যৌন আবেদন তাঁকে ইতিহাসের খাতায় নাম উঠিয়েছে। তাঁর পারভারটেড জীবনের স্বাভাবিকতাহীন আকাঙ্ক্ষা ও অদ্ভুত বিকৃত চেতনার জন্য মনোবিজ্ঞানে স্যাডিজম শব্দের আবির্ভাব। তাঁর ধারণা ছিল, পৃথিবীটা অত্যন্ত কদর্যময়, নিষ্ঠুর, হিংসা আর পাপে পরিপূর্ণ। এছাড়া প্রকৃতির নিজের মাঝেই আছে ধ্বংস প্রবৃত্তি। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, বন্যা, খরা, মরণব্যাধি ইত্যাদি। এসব সাদ বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন নস্টিক। নস্টিকরা বিশ্বাস করতেন, শয়তান বা একজন ডেমি আর্জ এ পৃথিবী পরিচালনা করে থাকেন। দূর থেকে তিনি এই অনাচার দেখে মজা পান। মারকুইস ডি সাদের বেশ কয়েকটি উপন্যাস আছে। এমনকি চলচ্চিত্রও বানানো হয়েছে উপন্যাসকে ভিত্তি করে। ব্যক্তিগত জীবনে অবাধ আচরণের জন্য বেশ কয়েকবার জেলে যান। সাদ যে উপন্যাসগুলো রচনা করেন, তাদের শরীর ছাড়া কোনো মন নেই, নেই মনন। সাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে পুরোপুরি পাশবিক স্তরে নামিয়ে আনা।

সাদের রচনা এক সময় ভদ্র সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। মানুষ লুকিয়ে পড়তো। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে। ফ্রান্স মুক্ত হলো, মুক্ত হলো বেলজিয়াম। অন্যদিকে চেক ও রোমানিয়াও মুক্ত রাশিয়ার হাতে। ঠিক এমন সময় জার্মান থেকে থিওডর আর্ডোনা ও মার্কস হোর্কহাইমার হিটলারের জার্মানি থেকে আমেরিকাতে পালিয়ে এসে দুটো বই লেখেন। বইটা হচ্ছে ডাইলেক্টিক্স অব এনলাইটমেন্ট। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে যে আশাবাদ জেগেছিল, মানুষের মুক্তির যে সিঁড়ি তৈরি হয়েছিল সেটা পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে লুকিয়ে থাকা রাক্ষস সম্পূর্ণ গিলে খেয়েছে। কাজেই এই চাকচিক্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে বিরাট এক হিংস্রতা। তাঁরা মনে করেন, এই বিষয়টা প্রথম আঁচ করতে পারেন মারকুইস ডি সাদ। তাঁরা যেন এটাই বলতে চেয়েছেন, এখন কান্ট নয় বরং আমাদের পড়তে হবে সাদ। কলঙ্কিত সাদ সেই প্রথম জাতে উঠলেন। অতঃপর ১৯৭০ এর দশকে ফ্রান্স থেকে সাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে তিনি ভদ্র সমাজে প্রবেশ করেন। সেডিজম আজ অতি প্রকাশ্য এক বাস্তবতা। মহাভারতে দ্রৌপদির ওপর সম্মিলিত অত্যাচার যেন বহু পুরোনো সেডিজমের পৌরাণিক এক সাইকো-ডিজঅর্ডার। অনেক গবেষক বলছেন, স্যাডিজম সর্বব্যাপী এক মনবৈকল্য; যা জাতি, ধর্ম, দেশ কালের ঊর্ধ্বে।

দল্যুজ সাদের স্যাডিজম ও মেসসিজিমের এ ব্যাখ্যার সাথে একমত নন। স্যাডি-মেসসিজমের বাস্তবতা নেই। দল্যুজ এ সংক্রান্ত জার্মান মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ভন ক্র্যাফট-এবিংয়ের মতামতকে সমালোচনা করেন। যদি ধরা যাক একজন স্যাডিস্টের সাথে একজন মেসোসিস্টের দেখা হলো। দু’জনের চরিত্র যেহেতু বিপরীত তাই স্যাডিস্ট চাবুক মেরে খুশি; মেসোসিস্ট চাবুক খেয়ে সমান পরিমাণ খুশি। কিন্তু স্যাডিস্ট চাইছে মেসোসিস্ট চিৎকার করুক, অত্যাচারিত বোধ করুক কিন্তু মেসোসিস্ট তো তা করবে না। সেজন্য স্যাডিজম কথাটা প্রকারন্তরে অর্থহীন হয়ে গেল।

দল্যুজ তাঁর মেসসিজমের শেষের দিকে ফ্রয়েডকে সমর্থন জানিয়েছেন বিশেষ করে The Death Instinct তত্ত্বকে। ফ্রয়েডের মূল দার্শনিক তত্ত্বটি এরকমঃ ক) মানুষের জীবনের প্রধানতম তাড়না হচ্ছে সুখানুভূতি বা প্লেজার প্রিন্সিপ্যাল। আমরা প্রতিনিয়ত এমন কাজ করি বা এমন কাজ করতে পছন্দ করি যা আমাদের আনন্দ দেয়। সেটা ভালো খাবার হতে পারে, হতে পারে ভালো চাকরি, ভালো বাড়ি অথবা সুন্দর সঙ্গী। খ) অন্যদিকে ফ্রয়েড রিয়েলিটি প্রিন্সিপ্যালের কথা বলেছেন, যা আমাদের সব সমাজ অসমর্থিত কাজ থেকে বিরত রাখে। যেমন মন চাইলেই আমরা সব কাজ করতে পারি না। করিও না। নির্দিষ্ট বিধি নিষেধের সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে আমরা চলাচল করি। গ) মানুষ বা প্রাণী অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকতে চায়। এই ইচ্ছে বা ইন্সটিংক্ট থেকে সুখানুভূতির শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়।

ফ্রয়েড মনে করেন, প্রাণিকূলের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে শারীরিক সুখের শেষ পর্বে অর্থাৎ ইতিহর্ষের পরে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল থাকা। এটাকেই তিনি এরস (Eros) ও থ্যানাটস (Thanatos) বলেছেন। এটাই তাঁর মর্ত্যুকাম তত্ত্ব। উল্লেখ্য ফ্রয়েড যখন এসব লেখেন, তখন ছিল ১৯২০ সাল। অর্থাৎ সবে যুদ্ধ থেমেছে। যুদ্ধ ও ধ্বংস প্রবৃত্তি এবং বর্বরতা মানুষের এই চিরায়ত বৈশিষ্ট্যেরই যেন এক অবধারিত চেহারা। জিল দল্যুজ তাঁর মেসোসিজমে ফ্রয়েডিয় এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন। এরপর দল্যুজ তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্বে পৌঁছান যেটা তিনি ব্যক্ত করেন তাঁর মেগনাম অপাস ডিফ্রেন্স অ্যান্ড রিপিটেশনে।

ডিফ্রেন্স অ্যান্ড রিপিটেশন জিল দল্যুজের লেখা ডিফ্রেন্স অ্যান্ড রিপিটেশন পৃথিবীর অতি দুর্বোধ্য বইয়ের একটি। দল্যুজের অন্য বই থেকে আলাদা তো বটেই। এটি তাঁর পিএইচডির অভিসন্দর্ভ হওয়ার কারণে দুর্বোধ্যতার স্কেল সবচেয়ে সাংঘাতিক। ১৯৯৪ সালে লন্ডনে বইটির ইংরেজি তরজমা বের হয়; যদিও এটি ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে এটি বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে, দর্শনে একটি নতুন বৈপ্লবিক মেথড হিসেবে বইটি আমাদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। আদতে তিনি এর ভেতর দিয়ে সত্তার বা বাস্তবতার একটা নতুন কাঠামো দিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মূল্যবোধ ও কর্মধারার একটা নতুন প্রবাহ। এটার ভেতর দিয়ে সম্ভবত তিনি জীবনের একটা নতুন পথ ও তার সাথে একটা ভিন্ন দার্শনিক বোধের পথ বাতলিয়েছেন।

দিল্যুজকে এন্টি-হেগেলিয়ান হিসেবে আমরা চিনি। সাথে সাথে তিনি এন্টি-ডাইলেক্টিক্যালও। কিন্তু ডেনিয়েল স্মিথ বলছেন, তাঁকে এন্টি-ডাইলেক্টিক্যাল হিসেবে আখ্যা দেওয়া উচিত হবে না। বরং ডিফ্রেন্স অ্যান্ড রিপিটেশনে তিনি ডাইলেক্টিক্সের এক নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হেগেলের ইডেন্টিটি ও নেগেশন বিপরীতে তিনি ডিফ্রেন্স অ্যান্ড রিপিটেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডিফ্রেন্স এখানে নেগেটিভ, যা প্রকারন্তরে বিরোধের কথা বলে। তিনি মনে করেন, হেগেলের বিপরীতে তিনি একটি সৃজনশীল যুক্তি থেকে ধারণা তৈরি করেছেন, যা দ্বান্দ্বিকতার দ্বিত্ববাদকে প্রতিরোধ করে। তিনি একটা চলমান দিগন্ত বরাবর তাঁর ধারণাগুলোকে তৈরি করেন, ভেঙে ফেলেন এবং পুনর্নির্মাণ করেন। সেটি করেন বিকেন্দ্রিকৃত কেন্দ্র থেকে, স্থানচ্যুত পরিধি থেকে; যা অন্যদের থেকে আলাদা করে এবং পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম