বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে বিএনপির এক দফার আন্দোলনে কৌশলগত পরিবর্তন আনা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এবার আন্দোলনের ধরন ‘ভিন্ন রকম’ হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
Advertisement
শনিবার (১ জুলাই) বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়কালে চলমান আন্দোলন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সারাদেশে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ হচ্ছে। সামনে আমাদের পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু হবে। আশা করি, এক দফা নিয়েই আমরা আন্দোলনে যাবো। আমাদের যে পূর্বঘোষিত ১০ দফা এবং অন্য যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলোর যেসব দফা আছে সবগুলো মিলিয়ে এক দফার আন্দোলনে যাবো। আর সেটা হচ্ছে, এই অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান। এগুলোকে নিয়ে আমরা একটি জায়গায় আসছি...। সেটা হচ্ছে এ সরকারের পদত্যাগ।
আরও পড়ুন: শিগগির আসছে একদফা আন্দোলনের ঘোষণামির্জা ফখরুল বলেন, এবার আন্দোলনের ধরনে পরিবর্তন আসবে। ভিন্ন ধারার আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততাও বাড়বে। আমরা শুরু থেকেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন করছি। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দিনের এক দফার আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সরকার নতি স্বীকার, পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবে।
এক দফার আন্দোলনের ধরন কেমন হবে, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে কি না- জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আগেই বলেছি, আমরা হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচিতে সচেতনভাবে চাচ্ছি না। আমাদের ভায়োলেন্সে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। তিনি বলেন, সরকার যদি কোনোভাবে আমাদের সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয় তবে সে দায় সরকারের। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।
Advertisement
আরও পড়ুন: খালেদা-ফখরুলের ২ ঘণ্টার বৈঠক
সরকারের সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ, জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা। কয়েকটা বইও বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের যে একটা ব্যাপার বারবার বলা হচ্ছে, এটা আসলে ‘উন্নয়ন বিভ্রম’। এটা দিয়ে মানুষকে বোকা বানানো হয়, প্রতারণা করা হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে যে তথ্য দেওয়া হয় সেগুলো অনেকাংশেই সঠিক নয়। সরকার এটা শুরু থেকে করে আসছে।
তিনি বলেন, এতই যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে, কৃষিক্ষেত্র যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে আজকে কেন প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়? মরিচের দাম বেড়েছে, আদার দাম তো একদিনে কেজিতে ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। এরকম প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, সরকার দেশটাকে আমদানিনির্ভর করে ফেলেছে। এর কারণ একটাই, আমদানি করতে গেলে যে কমিশন পাওয়া যায়, যে লাভ হয় এটাই হচ্ছে প্রধান বিষয়। এই সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লুটপাট। আমি বলি যে, বর্গিদের মতো। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় চেপে বসে আছে তাদের আচরণ পুরোপুরি বর্গিদের মতো। তারা লুট করে নিয়ে চলে যাবে। সব জায়গায় চুরি-দুর্নীতি.. এটাকেই তারা বলে উন্নয়ন। এ নিয়েই তারা বাগাড়ম্বর করে।
সরকার মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, যখন অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, ধসে পড়ছে, যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে, জনগণ তাদের দুঃখের কথা বলতে শুরু করেছে, ইনফ্লেশন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে, তখন সরকার উল্টো কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তবে এতেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
Advertisement
আরও পড়ুন: জাতীয় সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়: চরমোনাই পির তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এনাফ ইজ এনাফ…। এখনো সময় আছে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়া উচিত। এটা সরকারের জন্যই ভালো হবে। দেশেরও জন্য মঙ্গল হবে।
নির্দলীয় সরকারের বিষয়টি সংবিধানে সংযোজন ‘সরকারের দায়িত্ব’ বলে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা আছে। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। সরকারের জনগণের প্রতি যদি ভালোবাসা থেকে থাকে, দেশের প্রতি যদি কোনো প্রেম থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এই রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসা। তিনি বলেন, আলোচনা করেই সরকার একটা পথ বের করতে পারে। এটা অতীতে বাংলাদেশে হয়েছে। এটা খুব কঠিন কাজ না। কিন্তু তাদের গুড ইনটেনশন থাকতে হবে, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। তাহলেই সেটা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: লবিস্ট দিয়ে বিবৃতি আনা দেশদ্রোহিতার শামিল: তথ্যমন্ত্রী
‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বি-টিম’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, এগুলো বাজে কথা। তারা ইচ্ছা করে এসব কথা বলে। আমরা এসব কথার উত্তর দিতে চাই না। জনগণই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের সব কথার উত্তর দেবে।
জামায়াত নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামায়াত একটা রাজনৈতিক দল, অনেক বছর ধরে রাজনীতি করছে, জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক দল। যদিও এখন জামায়াতের নিবন্ধন নেই। আমি ঠাকুগাঁওয়ে যে কথাটা বলেছিলাম, জামায়াতে ইসলামী একটা রাজনৈতিক দল, সে তার নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের মূল কথাটা হচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে তাদেরই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, জামায়াতে ইসলামী নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে। আরও অনেক দল যারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই, কিন্তু সরকার পতনের আন্দোলন করছে। এ সরকারবিরোধী সব দলকে ওয়েলকাম জানিয়েছি।
সরকার ডানপন্থিদের উত্থান চায় দাবি করে ফ্রান্সের ঘটনাবলি ও ইউরোপের ডানপন্থিদের উত্থান সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যখনই গণতন্ত্র সঠিকভাবে চলতে না পারে তখনই এসব সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিমা বিশ্ব ও বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে। কারণ, পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র ইনস্টিটিউশনালাইজ…। আমাদের এখানে সেটা নেই।
আরও পড়ুন: শিগগির নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি তিনি বলেন, তারপরও এখানে যদি গণতন্ত্রকে স্পেস দেওয়া না হয়, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, মানুষ যদি গণতান্ত্রিক অধিকার না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে ডানপন্থি, উগ্রপন্থি, ফান্ডামেটালিজ, জঙ্গিবাদ এগুলোর উত্থান হবে। সে কথাগুলো আমরা বারবার বলছি। তিনি আরও বলেন, আজকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও আমরা কেউই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান চাই না, আমরা কেউই এখানে ডানপন্থিদের চূড়ান্ত রূপের কাছে যেতে চাই না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে যে মূল বিষয়টা ছিল আমরা সত্যিকার অর্থেই সেই উদারপন্থি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মির্জা ফখরুল বলেন, ডানপন্থিদের উত্থান তখনই হয় যখন গণতন্ত্রের স্পেস থাকে না। মানুষ যখন কোনো রাস্তা পাবে না, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করতে পারবে না, তখন তো ভিন্ন দিকে যাবেই। সে রাস্তাই তৈরি করে দিচ্ছে এ অবৈধ সরকার। তারা দেশে এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে, মনে হচ্ছে তারা চায় ডানপন্থি শক্তির উত্থান। দেশকে তারা সেদিকেই ঠেলে নিচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সদস্যসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সদস্য শায়রুল কবির খান এবং সমাজকল্যাণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। কেএইচ/এমকেআর/এমএস