বর্তমান সরকারের আমলে, শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রায় সব খাতে দৃশ্যমান হলেও ফুটবলের উন্নয়ন দূরবিনেও খুঁজে পাওয়া যায় না। র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকা ছোট দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে গিয়েও রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে দেশের ফুটবলারদের। কিন্তু দেশের ফুটবলে কাজী সালাউদ্দিনের যুগ শুরুর আগে পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না।
Advertisement
ঈদের আগে খবরে দেখেছিলাম ফিফা ও সরকারের দেওয়া অর্থ নিয়ে দুর্নীতি, অর্থপাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী।
সৎ সাহসের এত অভাব যে, সততার সাথে একটা সাধারণ বিচারিক প্রক্রিয়ারও মুখোমুখি হতে চায় না কাজী সালাউদ্দিন গ্রুপ। বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগসহ সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চেয়ে গত মে মাসে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে আমরা ক্রিকেটে ভালো করছি, শুটিংয়ে ভালো করছি, মেয়েরা ক্রিকেট এবং ফুটবল দুটোতেই ভালো করছে, আর্চারিতে ভালো করছি। একমাত্র ফুটবলের ক্ষেত্রেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাংলাদেশ। কাজী সালাউদ্দিন নামের একজন আজ আলোচনায়। দেশের ফুটবলের ধারাবাহিক অবনতির দায় তার ওপর বর্তায়। কিন্তু তিনি আছেন অনন্তকাল ধরে এবং হয়তো থাকবেন আমৃত্যু।
Advertisement
বার বছর তথা এক যুগ পেরিয়ে ১৫ বছর ধরে চলছে কাজী সালাউদ্দিনের বাংলাদেশ ফুটবল। ১৫ বছর আগে দেশের ফুটবলের দায়িত্ব কাজী সাহেবের হাতে উঠেছে দেখে তাই আশাবাদী হয়েছিলেন ফুটবল-সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। বাফুফেতে সালাউদ্দিন সহযোগী হিসেবেও পেয়েছিলেন সাবেক তারকাদেরই। কিন্তু অপ্রিয় সত্যি হলো, বাফুফে সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের এই ১৫ বছর শুধুই ব্যর্থতার ইতিহাস, ফুটবল জগতে অপেশাদারিত্বের ইতিহাস, ফুটবলকে ভালোবাসা মিডিয়া ও জনগণকে অজজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ইতিহাস।
ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই নিচের দিকে নেমেছে। যে সাফ অঞ্চলে একটা ভালো অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের গর্ব ছিল, সেটিও আজ অতীত। যদি প্রশ্ন করা হয়, তিনি বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলায় বাংলাদেশ গ্রুপপর্ব থেকেই কতবার বিদায় নিয়েছে, আমার ধারণা কাজী সালাউদ্দিন তা বলতে পারবেন না।
একটা মানুষ যে দিনরাত আসক্ত হয়ে থাকেন অন্য খেলায় তিনি কি ফুটবলের খোঁজ রাখবেন? প্রতিশ্রুতি দিয়েও তৃণমূল থেকে ফুটবল প্রতিভা বের করে আনার দৃশ্যমান চেষ্টা ছিল না। জেলা ফুটবলের উন্নয়ন কিংবা সারা দেশে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কাজেও সালাউদ্দিন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই দেড় যুগে সালাউদ্দিন বিতর্কিত ও অসৎ ব্যক্তিদের কাছে টেনেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
বাংলা ফুটবলের ইংরেজি অভিভাবক হিসেবে পরিচিত জনাব সালাউদ্দিন। তিনি বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি বলেন এবং নিজের সাথে এক সময় যারা খেলেছেন তাদেরও অবজ্ঞা করেন বলে সবাই বলে। সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন বাফুফের নির্বাহী সভায় সাংবাদিকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের নিষেধাজ্ঞা, বাফুফের অনিয়ম, দুর্নীতি-জালিয়াতিকাণ্ড সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই সাংবাদিকদের শত্রুর আসনে বসিয়েছেন সালাউদ্দিন। তারই কারণে সাংবাদিকদের পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তিনি।
Advertisement
ফাঁস হওয়া অডিওতে শোনা যায় সালাউদ্দিন পাশে থাকা বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদী, সহ-সভাপতি কাজী নাবিল ও সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভুইয়া মানিকের কাছে বলে ওঠেন, জার্নালিস্টরা এখানে ঢুকতে গেলে ফটো (ছবি) দিতে হবে তাদের বাপ-মা'র। বলেন, ‘আরেকটা কন্ডিশন হলো তার বাপের ফটো পাঠাতে হবে জুতা পরা। ঠিক আছে (হাসি)? এটা হতে হবে মেন্ডেটরি। বাপের জুতা পরা ছবি থাকতে হবে।’ এই বক্তব্য বেরিয়ে এলে চারদিকে নিন্দার ঝড় ওঠে। পরে ক্ষমাও চান তিনি।
এক সময়ের তারকা ফুটবলার হিসেবে তিনি যতটা আলো ছড়িয়েছিলেন সংগঠক হিসেবে ততটাই অন্ধকারের দিকে নিয়ে গেছেন তিনি দেশের ফুটবলকে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে বড় স্বপ্ন দেখিয়েই বাফুফে সভাপতি হয়েছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। তার কাছে প্রত্যাশাও ছিল বেশি। কিন্তু প্রত্যাশার সামান্যও পূরণ করতে পারেননি তিনি। তার আমলে বাংলাদেশের ফুটবল র্যাংকিং কমেছে, দুর্নীতির আন্তর্জাতিক বদনাম হয়েছে দেশের। সালাউদ্দিনের সময় বাংলাদেশ ভুটানের মতো দলের কাছেও হেরেছে। মালদ্বীপের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশ ৫-০ গোলেও হেরেছে।
কাজী সালাউদ্দিনের জামানায় দেশের ফুটবল হেরেছে, তবে ফেডারেশনের ভিতরে দুর্নীতি জিতেছে, দলবাজি জিতেছে, অহংকার জিতেছে। তিনি খেলেছেন এক সময়, তবে অভিভাবক হিসেবে তার আসলে কিছু দেওয়ার ছিল না এবং দিতেও পারেননি। কাজী সালাউদ্দিন ফুটবলের কাঠামো এবং ফুটবল মনস্তত্ব এমন এক দূরবর্তী স্থানে নিয়ে গেছেন এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে হয়তো ফুটবল খেলাটাই উঠে যাবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এএসএম