এক সময়ে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক আর তাদের পরিবার-পরিজনের পদভারে মুখরিত খুলনার পাটকল অধ্যুষিত শিল্পাঞ্চল আজ যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। কাজ না থাকা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক ও তাদের পরিবার। এখনো যারা শিল্পাঞ্চলে রয়েছেন তারা কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।
Advertisement
অসহায় এই শ্রমিকরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে জানান, পত্র-পত্রিকায় তাদের ছবি দিয়ে লিখলে সমস্যা হয়। সাক্ষাৎকার দিলে খুঁজে বের করে ভয়ভীতি দেখানো হয়। তাই তারা কোনো কথা বলতে চান না। তাই যেভাবে আছেন সেভাবেই কোনোরকমে বেঁচে থাকতে চান। তবে তারা চান, এই মিলগুলো আবার চালু হোক।
শ্রমিকরা জানান, লোকসানের কারণে ২০২০ সালে তিন মাসের জন্য উৎপাদন বন্ধের কথা বলে মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর তিন বছর অতিবাহিত হলেও মিলগুলো চালুর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মিল চালু না হলেও কোয়াটারগুলোতে অবস্থান করা শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে কোনোরকমে টিকে ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও তাদের বিতাড়িত করা হয়। ফলে দুর্বিষহ এক জীবন কাটছে শ্রমিক পরিবারের।
শিল্পাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জুটমিল দি ক্রিসেন্ট জুটমিলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এক দশক আগেও এই মিলের সামনে রাত-দিন শ্রমিক কর্মচারীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকলেও সেখানে যেন মাছিও পড়ে না। মিলগেটের দুইপাশের কয়েকটি দোকান চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
Advertisement
ভেতরের অবস্থা দেখার জন্য প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন দারোয়ান। তিনি নাম প্রকাশ না করেই বলেন, আপনারা চলে যান। এখানে কেউ নেই, কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
দৌলতপুর জুট মিলস, পিপলস জুট মিলস, নিউজ প্রিন্ট মিলস, হাডবোর্ড মিল সবই বিএডিসি রোডে। মিলগুলো চালু থাকা অবস্থায় এই রোডের দুইপাশে যেসব দোকানপাট গড়ে উঠেছিল, এখন তার সিকি ভাগও খোলা নেই।
বিএডিসি রোডের পাশের বাসিন্দা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, মিলগুলো যখন চালু ছিল তখন অনেক শ্রমিক-কর্মচারী ভাড়া বাড়িতে থেকে চাকরি করেছেন। কিন্তু মিল বন্ধ হওয়ার পর তারা অনেকেই ভাড়া না দিতে পেরে রাতের আঁধারে চলে গেছেন।
বিএডিসি রোডের তৈয়বা কলোনি এলাকা মুদি দোকানি শামিম শেখ জানান, তার দোকান থেকে কয়েক শত শ্রমিক-কর্মচারী লেনদেন করেছেন। মাস শেষ হলে বেতন পেয়েই তারা দোকানের বকেয়া দিয়ে দিতেন। ফলে এক সময় দোকান ভালো চলেছে। কিন্তু মিল বন্ধ হওয়ায় অনেকেই বাকি নিয়ে আর শোধ করতে পারেননি। না বলেই চলে গেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই। ফলে দোকানে এখন ঠিকমতো মালামাল তুলতে পারছেন না।
Advertisement
প্লাটিনাম জুবিলি জুটমিলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী সাহানা পারভীন বলেন, খুলনার ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ৩০ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। পাটকলের কাজ ছাড়া আর কিছুই জানেন না তারা। ফলে কর্মহারা হলেও অন্য কোনো পেশায় তারা যেতে পারছেন না।
মিলে কাজ করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ খালিশপুর এলাকায় এসে বসবাস করতেন। তাদের অনেকেই চলে গেছে। তাই, খালিশপুর অঞ্চল এখন প্রায় নির্জন হয়ে গেছে।
পাটকলগুলো সরকারিভাবে চালুর কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বেসরকারিভাবে চালুর চেষ্টা করছে সরকার জানিয়ে বিজেএমসি খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. গোলাম রব্বানি বলেন, বেসরকারিভাবে মিলগুলো চালুর কার্যক্রম দ্রুত গতিতে চলছে। খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের জন্য টাকা জমা দিয়েছে ফরচুন গ্রুপ। ঈদের পর তারা দৌলতপুর জুট মিলের টাকাও জমা দেবে। এছাড়া যশোরের জেজেআই হস্তান্তর করা হয়েছে আকিজ গ্রুপের কাছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, খুলনার আরও পাঁচটি মিল বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এই মিলগুলো হলো স্টার, খালিশপুর, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন এবং কার্পেটিং জুট মিল। তিনি বলেন, খুব দ্রুত এই মিলগুলো বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আর্থিক ক্ষতির কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের ২০ জুলাই খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে চাকরি হারিয়ে ফেলেন খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলোর স্থায়ী-অস্থায়ী ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সরকার এ ২৫টি পাটকলের মধ্যে ১৭টিকে বেসরকারি খাতে পাঁচ থেকে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এমআরআর/জিকেএস