আষাঢ় মাস চলছে। এসময় হাওরে পানি থই থই করার কথা। অথচ সেখানকার মাটি শুকিয়ে গেছে। পানি না থাকায় মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন পানিতে মা মাছ ডিম ফুটিয়ে বংশবৃদ্ধি করলেও এবার তা হচ্ছে না। এতে দেশি মাছের কয়েকটি জাত বিলুপ্তের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। হাওরে ঝিনুক, শামুকসহ ডুবোজলের উদ্ভিদের অস্তিত্ব কমে যাওয়ায় হাঁসের খামারগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।
Advertisement
সরেজমিন দেখা গেছে, অল্প কিছু জমে থাকা পানি ছাড়া প্রায় পুরো হাওর শুকিয়ে গেছে। পানি না থাকায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। এতে মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায় বিপাকে পড়েছে। তারা জানান, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা ও ভৈরবে রাতের মাছের বাজারে প্রতিদিন তিন কোটি টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন দুই মোকামে এক কোটি টাকার মাছও বিক্রি হয় না।
নেত্রকোনার মদন উপজেলার জেলেপাড়ার বাসিন্দা মদন ধর, মধুবন ধরসহ কয়েকজন জানান, বৈশাখ মাসের শুরুতেই হাওরে পানি আসা শুরু হয়। ১৫ তারিখের পর পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে হাওরে পানির বিশাল ঢেউ লক্ষ্য করা যায়। এসময় নতুন পানিতে মা মাছ বাচ্চা ফুটিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। এবার পানি না থাকায় মা মাছ মারা গেছে।
শুষ্ক থাকায় হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। ঝিনুক, শামুক ও জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব কমে গেছে। হাঁসের খাবার কিনতে হচ্ছে বাজার থেকে। খামারিরা জানান, হাওরে হাঁস ছেড়ে দিলে তারা ৬০ শতাংশ খাবার সংগ্রহ করতে পারতো। খামার থেকে তাদের বাকি ৪০ শতাংশ খাবারের জোগান দিতে হতো। এখন পানি না থাকায় ৮৫ শতাংশ খাবার কিনতে হচ্ছে।
Advertisement
‘হাওর অঞ্চলবাসী’ সংগঠনের সমন্বয়কারী প্রকৌশলী এনায়েতুর রহমান বলেন, ‘আগামী কয়েক বছর পর দেশে মিঠাপানির মাছের অস্তিত্ব থাকবে না। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। এতে আগামী প্রজন্ম খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এ নিয়ে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়তে হবে।’
হাওর ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আজহার আলী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি হাওরে অপরিকল্পিত সড়ক, রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণের কারণে এবং হাওরে বাঁধ দিয়ে নদীর পানি আটকে দেওয়ায় প্রতিবছর পানি কমে যাচ্ছে। হাওরের উন্নয়ন যথাযথ সমীক্ষাভিত্তিক হচ্ছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সমীক্ষার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, বর্ষায় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন ও মৎস্যজীবীরা হাওরের পানিতে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এবার হাওরে পানি না থাকায় জেলেপল্লিতে মাছ ধরার উৎসব নেই। জেলেরা প্রায় বেকার হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে হাওর গবেষক সঞ্জয় সরকার বলেন, হালদায় মেজর কার্পজাতীয় মাছের অনুকূল তাপমাত্রা হচ্ছে ২২-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। মেজর কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা মা মাছের প্রজননের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেজন্য হালাদায় কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন চক্রের সময় আরও বাড়তে পারে, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে, ডিম্বাণুর পূর্ণতা প্রাপ্তিতে দেরি হতে পারে, হরমোনের ভারসাম্যহীন হয়ে ডিম উৎপাদন কমে যেতে পারে অথবা কমসংখ্যক মা মাছ প্রজনন পরিপক্বতা অর্জন করতে পারে।
নেত্রকোনা মৎস্য কর্মকতা শাহজাহান কবির বলেন, তাপপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হওরের পানি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যাপকভাবে বন-জঙ্গল কমিয়ে ফেলা বৃষ্টি কম হওয়ার অন্যতম কারণ।
Advertisement
এইচ এম কামাল/এসআর/জিকেএস