এই যে সারা বছর ধরে শোনা যায়, আমাদের দেশের গবেষণা খাতের চরম দুরবস্থা, বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকার আক্ষেপ। অথচ সেই দুরবস্থা ও আক্ষেপের জায়গাটি থেকে বের হয়ে আসার নায়কোচিত বিজয় গাঁথাও কি আমাদের কানে আসে?
Advertisement
সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও আমাদের দেশের তরুণ যুব সমাজের মধ্যেই এমন অনেকে আছেন যারা নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে নিজেকে ও সর্বোপরি দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করে চলেছেন। শত বাঁধাকে পেছনে ফেলে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছেন অসাধ্য সাধনের প্রয়াস বুকে নিয়ে।
আজ শোনাবো এমনই এক দুর্দম তরুণের গল্প। নাম তার বিজন কুমার- যার তিলেতিলে গড়ে তোলা গবেষণা-ভিত্তিক সংগঠন, ‘বিকে স্কুল অব রিসার্চ’ আজ দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছড়াচ্ছে। এমনকি অনন্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে অর্জন করে নিয়েছে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ আওয়ার্ড ২০২২’!
বিজন কুমারের জন্ম নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলায়। বাবা, দীনেশ চন্দ্র পিকে, পেশায় কৃষক এবং মা, যোগমায়া, পেশায় গৃহিণী। বিজন কুমার, স্থানীয় স্কুল ও কলেজ থেকে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে দুই জায়গাতেই তিনি জিপিএ ৫ অর্জন করেন। তারপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
Advertisement
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনাকালীন, ২০১৫ সালে বিজন গড়ে তোলেন তার গবেষণা সংগঠন বিকে স্কুল অব রিসার্চ। এরপর ২০১৭ সালে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসাবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ২০২০ সালে ‘‘International Youth Society for Sustainable Development’’ নামে তিনি গড়ে তোলেন আরও একটি সংগঠন। বর্তমানে বিজন কুমার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত। গত বছর শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্য অবদান রাখার জন্য বিজন কুমারের প্রতিষ্ঠিত বিকে স্কুল অব রিসার্চ ‘জয় বাংলা ইয়ুথ আওয়ার্ড ২০২২’ অর্জন করে।
বিজন কুমারের কাছ থেকেই শোনা যাক, তার সাফল্যের ইতিবৃত্ত। তিনি বলেন, বছর আট আগে আমি মাস্টার্সের থিসিস করছিলাম। দারিদ্র্য বিমোচন এবং পারিবারিক কল্যাণ বৃদ্ধিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা কেমন, তা নিয়েই ছিল মূলত আমার থিসিস। গবেষণার নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে গবেষণার খুঁটিনাটি বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকলেও, সে মোতাবেক জানার সুযোগ ছিলো কম। সমস্যাটি যে শুধু আমার হচ্ছিলো তা নয়, খোঁজ নিয়ে দেখি আমার মতো অনেকেই একই সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
‘২০১৫ সালের দিকে ইন্টারনেটে গবেষণার বিভিন্ন তথ্য যেমন বেশ অপ্রতুল ছিল, তেমনি আমাদের কাছে ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সুবিধাও পর্যাপ্ত ছিল না। আবার তরুণ শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে সাহায্য করে এ রকম সংগঠনও খুব একটা চোখে পড়লো না। এমন অবস্থায় চিন্তা করলাম, আমরা নিজেরাই যদি কোনো সংগঠন গড়ে তুলি তাহলে গবেষণার নবীন শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জানার সুযোগ পাবে।’ বিকে স্কুল অব রিসার্চের গোড়াপত্তন কীভাবে হলো সে বিষয়ে বিজন বলেন, মাঝে মধ্যেই আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতাম। সে সময় নির্দিষ্ট কোনো বসার জায়গা আমাদের ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কমপ্লেক্সের সিঁড়িতে, কখনো সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বারান্দায়, কখনো শহীদ মিনার চত্বরে, কখনো মমতাজ উদ্দিন কলা ভবনের সামনে কিংবা সাবাস বাংলাদেশ মাঠে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ছিলো আমাদের পদচারণা। একদিন আড্ডাতেই আমি বন্ধুদের সামনে সংগঠনের ব্যাপারটা তুলে ধরলাম। বন্ধুরাও তাতে সায় দিলো।
‘এভাবেই ২০১৫ সালে পথচলা শুরু হলো ‘‘ইন্টারনাশনাল প্ল্যাটফরম অব ইকনোমিক রিসার্চ’’ সংগঠনের। যখন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয়ের তরুণ গবেষকরা এখানে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো তখন এটির একটি সর্বজনীন নাম দেওয়া জরুরি হয়ে পড়লো। নাম হলো- ‘‘Blooming Knowledge School of Research’’ যা সংক্ষেপে ‘বিকে স্কুল অব রিসার্চ’ নামেই এখন সমধিক পরিচিত।’
Advertisement
দেশে যখন গবেষণায় এত অনীহা তখন ‘বিকে স্কুল অব রিসার্চ’- এর অগ্রগতি কেমন তা জানতে চাইলে বিজন কুমারের অকাট্য জবাব, ‘দেখতে দেখতে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির ৭ বছর পার হয়ে গেছে। ৮ জন থেকে এখন আমাদের টিমে ২২টি দেশের ৫৫ জন গবেষক, ৩০০ তথ্য সংগ্রাহক, ১০ জন অফিস এক্সিকিউটিভ কাজ করছেন। আড্ডার ছলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিকে স্কুল অব রিসার্চ।’ নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বিজন কুমার বলেন, এ সংগঠন থেকে এখন পর্যন্ত ২০টি গবেষণা প্রকল্প আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে এলসভিয়ারের সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ ওপেন, উইল’র জার্নাল অফ পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, ট্রান্সন্যাশনাল প্রেস লন্ডনের রেমিট্যান্স রিভিউ এবং মালয়েশিয়ার ইউএসএম ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এশিয়া প্যাসিফিক স্টাডিজ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, বর্তমানে ৭টি গবেষণা রিভিউ পর্যায়ে এবং ১২টি গবেষণা মাঠ পর্যায়ে চলমান।’ বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন ও কল্যাণ বৃদ্ধি, নারী ক্ষমতায়ন, গুণগত শিক্ষা, গণস্বাস্থ্য, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যু নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করছে বিকে স্কুল অব রিসার্চ। বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপিনসহ বিভিন্ন দেশের দক্ষ গবেষক ও প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ৫টি ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার এবং ট্রেনিং আয়োজন করেছে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. ফাইজান আলী, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. বিবেক কুমার, এসআরএম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. ঘনশ্যাম পান্ডে, সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. আত্মান শাহ, দিল্লির মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. স্বাতী চাওলা, ফিলিপাইনের সাইরাস ওগোরিডা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ফারাহ নওয়াজ অন্যতম।
পাঁচ হাজারেরও বেশি তরুণ গবেষক ও শিক্ষার্থী এসব প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া, জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও বিশেষ দিবস উদযাপন, সপ্তসুধা নামক ম্যাগাজিন প্রকাশের পাশাপাশি বিনামূল্যে গবেষণা বিষয়ে কনসালটেন্সি ও মেন্টরিং, প্ল্যাগারিজম ও গ্রামাটিকাল এরর চেকিং সেবাদানসহ তরুণদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজ করছে ‘বিকে স্কুল অব রিসার্চ’।
নিজের প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বিজন কুমার আরও বলেন, আমাদের এখানে গবেষণা শিখে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বহু তরুণ দেশে-বিদেশে বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। ২০২০ সালে ‘‘BIMSSCON’’ কনফারেন্সে পোস্টার প্রেজেন্টেশনে শতাধিক গবেষণার মধ্যে আমাদের গবেষণা ১ম রানার আপ হয়েছিল। সম্প্রতি কোভিড বিষয়ক বিকে স্কুল অব রিসার্চের ২টি গবেষণাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ফিচার করেছে।
বিকে স্কুল অব রিসার্চ- এর ফান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রসঙ্গে বিজন বলেন, আমাদের কোনো স্পন্সর বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান নেই। তাই, সংগঠনের ব্যয়ভার আমরা ব্যক্তিগতভাবেই বহন করছি। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে যেসব গবেষক যুক্ত থাকেন তারা সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যয়ে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ নিজেরাই করে থাকেন। পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকায় যেমন আমরা নতুন দক্ষ গবেষক নিয়োগ করতে পারছি না, তেমনি আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের গবেষণা করতে পারছি না।
‘তবে আমরা বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং শিক্ষা-গবেষণা সংগঠন থেকে প্রজেক্টের মাধ্যমে ফান্ড পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শাহ্ আজম স্যার সর্বদা আমাদের সাংগঠনিক ও গবেষণার কাজে উৎসাহ ও পরামর্শ দেন। তার গবেষণার প্রাজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দৃঢ় নেতৃত্বের গুণাবলী এবং সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করে।’
বিকে স্কুল অব রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা না হলে কি হতেন-এ প্রশ্নে, এক মুহূর্ত না ভেবে বিজন কুমার অকপটে বলেন, শিক্ষক-গবেষক তথা বিকে স্কুল অব রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা না হলে আমার স্বপ্ন ছিলো একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার। এখনো সে স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করি। ছাত্রজীবনে দুটো শর্টফিল্মও বানিয়েছি৷ ভবিষ্যতেও বানাতে চাই। শিক্ষা, গবেষণা এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীর পথে হেঁটে যেতে চাই বহুদূর।
এমআরএম