কোরবানির পশু কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের হাসিল (খাজনা) বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন বগুড়ার বিভিন্ন হাটের ইজারাদাররা। সরকার নির্ধারিত খাজনার চেয়ে কোথাও দ্বিগুণ আবার কোথাও তিনগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
Advertisement
এই হাটগুলোর বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। নিয়ম না মেনে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সরেজমিনে বিভিন্ন হাট ঘুরে মিলেছে এ তথ্য।
দেখা গেছে, প্রতিটি হাটে হাসিল নিয়ে বাদানুবাদ হচ্ছে কোরবানির পশু কিনতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার পরেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন অনেক ক্রেতা। তাদের অভিযোগ, হাটে কোনো খাজনা তালিকা বা নির্দেশনা টানানো হয়নি।
সব হাটেই শেষ মুহূর্তে আসছে প্রচুর কোরবানির পশু। সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি হাটে পাইকারি ক্রেতা ও ব্যাপারীদের তৎপরতা বেশি। বিভিন্ন কারণে গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দামও বেশি। হাটে গরুর দামের সঙ্গে মিলিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে খাজনার টাকা। অথচ এটা গরু অথবা খাসিপ্রতি নির্ধারণ করার কথা।
Advertisement
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে বগুড়ার বেশিরভাগ হাটেই টোল আদায়ের তালিকা টানানো দেখা যায়নি। উল্টো অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য হাটগুলোতে আলাদা কর্মী বাহিনী তৎপর থাকার চিত্র দেখা গেছে। বগুড়া সদর, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ, গাবতলী ও শাজাহানপুরে বড় হাট রয়েছে ১৫টি। এর বাইরেও অনেক পশুর হাট রয়েছে। বড় হাটগুলোর মধ্যে মহাস্থান হাট, ধাপের হাট, বনানী হাট, সুলতানগঞ্জ হাট, সাবগ্রাম হাট অন্যতম।
প্রতিবছর কোরবানি উপলক্ষে অনেক স্থানে মৌসুমি হাট বসানো হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী, বগুড়ায় পশুর হাট বসেছে ৫৭টি। এই হাটগুলোর অন্যতম হলো মহাস্থান। গত বুধবার হাটের দিন দেখা গেছে, কোরবানির পশুর উঠেছে অনেক। মহাস্থান হাটে গরু কিনতে আসা ক্রেতারা জানান, এই হাটে রীতিমতো হাসিল সন্ত্রাস করা হচ্ছে। সেখানে গরুপ্রতি নির্ধারিত ৫০০ টাকার স্থলে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। ছাগলের জন্য নির্ধারিত ১৫০ টাকার স্থলে আদায় হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এছাড়া বিক্রেতারা এবারই প্রথম খাজনার আওতায় এসেছেন। তাদের গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।
জানা গেছে, মহাস্থান হাটের ইজারাদার হলেন বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগিবুল আহসান রিপুর শ্যালক শফিকুল ইসলাম। এর আগে গতবছর রিপু নিজেই এই হাটের ইজারাদার ছিলেন। এবার শ্যালককে দিয়ে হাট করাচ্ছেন।
একইভাবে বগুড়ার বড়বড় হাটগুলোর মধ্যে রনবাঘা হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান রাজ, ডাকুমারা হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার রহমান শান্ত, জামুর হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগ নেতা মতিন সরকার, চাঁদমুহু হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন (খাস আদায়) সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক, নামুজা হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব আলম, ধাপেরহাট নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগ নেতা মতিন সরকারের সহযোগী ময়না, কালিতলা হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশার ছোট ভাই মাহবুব খোকন, বনানী হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কবির আহম্মেদ মিঠু, কিচক হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাজাহান চৌধুরী, দাড়িদহ হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি টুটুল হোসেন।
Advertisement
বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজা পারভীন বলেন, প্রতিটি পশুর হাটে গরু-মহিষ প্রতি ৫০ হাজার টাকার ওপরে হলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং ৫০ হাজারের নিচে হলে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা করে আদায় করার নির্দেশনা রয়েছে। আর ছাগল-ভেড়াপ্রতি ১৫০ টাকা ইজারাদার টোল (খাজনা) নির্ধারণ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেইসঙ্গে প্রতিটি হাটে টোলের টাকা উল্লেখ করে তালিকা টাঙানোর জন্য সরকারি নির্দেশ রয়েছে।
একাধিক ক্রেতা জানান, প্রতিটি হাটে টোল আদায়ের জন্য কর্মী বাহিনী নিয়োগ দিয়েছেন ইজারাদার। তারা জোর করে দুই থেকে তিনগুণ বেশি টোল আদায় করছে। জানতে চাইলে ডাকুমারা হাটের ইজারাদার জুলফিকার রহমান শান্ত বলেন, বড় হাট সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে তার দলীয় কিছু ছেলে কাজ করছে। তবে জোর করে কোনো টাকা আদায় করা হচ্ছে না।
মহাস্থান হাটে গরুপ্রতি দ্বিগুণ ও ছাগলে তিনগুণ টাকা আদায় করা প্রসঙ্গে ইজারাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদের কারণে অতিরিক্ত আদায়কারী এবং হাট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেশকিছু লোক রাখতে হয়েছে। এছাড়া হাটের বার্ষিক ডাকে টাকার অঙ্কও বেড়েছে। তিনি দাবি করেন, এবার গরুপ্রতি ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা এবং বিক্রেতার কাছ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর ছাগলের জন্য নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা।
শহরের ভেতরে সাবগ্রাম ও কালীতলা হাটের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এই হাট থেকে গরু কিনে ক্রেতারা জানান, সেখানে ইচ্ছামতো ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত হাসিল নেওয়া হয়েছে। হাসিলের টাকা নিয়ে ইজারাদারের পক্ষে যে স্লিপ দেওয়া হচ্ছে তাতে শুধু গরুর মূল্য লেখা রয়েছে। হাসিলের অঙ্ক লেখা নেই। কোনো ক্রেতা এই রসিদ নিতে না চাইলে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাকে হাট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের কোনো অভিযোগ কেউ করেননি। তিনি এ বিষয়ে সজাগ রয়েছেন। প্রয়োজনে যে কোনো হাটে অতিরিক্ত হাসিল আদায় রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন।
এমআরআর/জেআইএম