জাতীয়

ঢাকার সড়কে পশুর হাট, যাতায়াত-দুর্গন্ধে ভোগান্তি

এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১৮টি স্থানে বসবে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় নয়টি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার নয়টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাপারীরা হাটে পশু আনতে শুরু করেছেন। তবে হাট এখনো সেভাবে না জমলেও হাটের নির্ধারিত স্থান ছাড়িয়ে পশু জাগয়া করে নিয়েছে সড়ক ও অলিগলিতে। এতে শুরু হয়েছে ভোগান্তি।

Advertisement

এই ১৮টির বাইরে ডিএসসিসির ডেমরার সারুলিয়া ও ডিএনসিসির গাবতলী গবাদি পশুর হাটে (স্থায়ী হাট) কোরবানির পশু বিক্রি করা হবে। তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি যে ১৮টি অস্থায়ী হাটের দরপত্র চূড়ান্ত করেছে, তার অধিকাংশ হাটের স্থান নির্বাচন নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট বাসিন্দাদের অভিযোগ, কিছু হাটের সীমানা মহল্লার অলি-গলিতেও চলে যায়। এতে ঈদের আগে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। এছাড়া রাস্তা বা গলিতে হাট বসানোর কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসা ও অফিসে আসা-যাওয়ায় অসুবিধায় পড়েন নাগরিকরা। দুর্গন্ধে মহল্লায় টেকা দায় হয়ে যায়।

তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দাবি, ঈদুল আজহার পশুর হাট ধর্মীয় উৎসবের অংশ। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু অসুবিধা হলেও তা নাগরিকদের মেনে নিতে হবে। কারণ, নগরে রাস্তা ছাড়া পশুর হাট করার মতো ফাঁকা জায়গা নেই। নাগরিকদের ভোগান্তি যাতে কম হয়, সে বিষয়টি দেখভাল করা হবে।

আরও পড়ুন: সরবরাহ বাড়লেও দাম বেশি, ক্রেতা কম

Advertisement

২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন মাঠে কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দিতো ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। তবে অধিকাংশ হাটের সীমানা মাঠ ছাড়িয়ে চারপাশে পাড়া-মহল্লার গলিতে চলে যেত। তখন এসব হাট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে মাঠে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর নির্দেশনা দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে মাঠে পশুর হাট ইজারা থেকে সরে আসে সংস্থা দুটি। যদিও এবার ডিএনসিসি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে পশুর হাটের দরপত্র চূড়ান্ত করেছে।

এদিকে রাস্তায় বা মহাসড়কে গরুর হাট না বসিয়ে খোলা জায়গায় বসানোর নির্দেশনা চেয়ে সম্প্রতি উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেছেন এক আইনজীবী। এ রিটে স্থানীয় সরকার সচিব, ধর্ম সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, ঢাকার পুলিশ কমিশনার ও ঢাকার দুই মেয়রকে বিবাদী করা হয়েছে।

আগামী ২৯ জুন ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী, ঈদের তিনদিন আগ থেকে মোট পাঁচদিন কোরবানির হাট বসার কথা। তবে ঈদের সপ্তাহখানেক আগ থেকেই রাস্তায় বাঁশ পুঁতে শামিয়ানা টাঙানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করেছেন ইজারাদাররা। অনেক হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পশুও আসতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন: ৪০০ গরু নিয়ে জামালপুর থেকে ঢাকার পথে ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন

Advertisement

উত্তর সিটির পশুর হাটকোরবানির হাট ইজারা বা তত্ত্বাবধানের কাজটি করে ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ। এই বিভাগের তালিকা অনুযায়ী, এবার ঢাকা উত্তর সিটির যে এলাকাগুলোতে অস্থায়ী পশুর হাট বসবে, সেগুলো হলো— বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং আফতাব নগরের ব্লক ই, এফ, জি, এইচ পর্যন্ত অংশের খালি জায়গা, দক্ষিণখানের কাওলা শিয়াল ডাঙ্গাসংলগ্ন খালি জায়গা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত খালি জায়গা, ভাটারা (সাঈদ নগর) পশুর হাট, মোহাম্মদপুর বছিলা এলাকার ৪০ ফুট সড়কসংলগ্ন রাজধানী হাউজিং ও বছিলা গার্ডেন সিটির খালি জায়গা, মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর সেকশনের (ইস্টার্ন হাউজিং) খালি জায়গা, ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত কাচকুড়া ব্যাপারীপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠের খালি জায়গা, খিলক্ষেত খাঁপাড়া উত্তর পাশের জামালপুর প্রপার্টিজের খালি জায়গা ও এর বাইরে গাবতলী স্থায়ী হাটে গবাদি পশু বিক্রি হবে।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠে প্রতি বছরই পশুর হাট ইজারা দেয় ডিএনসিসি। তবে এ হাট মাঠের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই। বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সরেজমিনে দেখা যায়, মাঠের বাইরে সড়কেও বাঁশ পুতে পশু বিক্রির স্থান তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা গরু নিয়ে আসছেন। তবে বেচা-কেনা শুরু হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা মশিউর রহমানের অভিযোগ, এই মাঠে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাধিক পশু রাখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রতি বছর এই হাটে ১০ থেকে ১৫ হাজার পশু আসে। তখন আশপাশের সব সড়কে হাট বসে যায়। এবারও একই অবস্থা তৈরি হবে। নাগরিক ভোগান্তিও বাড়বে।

এই হাটের ইজারা নিয়েছেন মো. হোসেন খান। আলাপকালে তিনি বলেন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মাঠের পাশাপাশি আশপাশের সড়কগুলোতেও পশু বিক্রি করা যাবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি। সে অনুযায়ী আমরা হাট বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে নাগরিকদের যাতায়াতে যাতে সমস্যা না হয়, সে ব্যবস্থা রাখা হবে।

একইভাবে ডিএনসিসির অন্য হাটগুলোও রাস্তার ওপর বসানোর প্রস্তুতি চলতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন: ডিজিটাল হাটে ৫০ হাজার পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা

জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির হাট একটি উৎসবে পরিণত হয়। যে এলাকায় হাট হয়, ওই এলাকার মানুষই সবচেয়ে বেশি আনন্দ-উল্লাস করেন। তবে হাটের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকদের কিছু সমস্যা হয় বলে জানি। এসব সমস্যা যাতে না হয়, সেজন্য ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।

দক্ষিণ সিটির পশুর হাটএকইভাবে দক্ষিণ সিটির তালিকা অনুযায়ী, হাজারীবাগে ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, খিলগাঁও মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, লালবাগের রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা, খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা (শাহজাহানপুর), লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন খালি জায়গা ও কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গায় কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট বসবে। সারুলিয়া স্থায়ী হাটেও কোরবানির পশু বিক্রি হবে।

ডিএসসিসির ওই তালিকা অনুযায়ী, যেসব এলাকায় হাটের কথা বলা হয়েছে, অধিকাংশ স্থানে খালি জায়গা দেখা যায়নি। প্রায় সবগুলো হাটই সড়ক-মহাসড়কের ওপর বসাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটির হাটগুলো নিয়ে নাগরিকদের আপত্তি বেশি।

যেমন- দক্ষিণ সিটির ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় হাট বসানোর যে দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে, বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সরেজমিনে গিয়ে সেখানে কোনো খালি জায়গা দেখা যায়নি। ওই এলাকার ধোলাইখাল সড়কের ওপরই বাঁশ পুঁতে পশু বিক্রির জন্য জায়গা তৈরি করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পশু নিয়ে এই হাটে আসছেন। এরই মধ্যে হাটের সীমানা ধোলাইখাল সড়ক ছাড়িয়ে আশপাশের গলিতেও ঢুকতে দেখা গেছে। ঈদের তিন-চারদিন আগে এই হাট দয়াগঞ্জ মোড় থেকে রায়সাহেব বাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ধোলাইখালের বাসিন্দা মঈন উদ্দিন।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর ঈদে এই জায়গার হাট ইজারা দেয় ডিএসসিসি। এতে সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের গলির সড়কগুলোতে হেঁটেও চলাচল করার উপায় থাকে না। অথচ ডিএসসিসির দরপত্রে এই এলাকার হাট উন্মুক্ত স্থানে বসবে বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল।

বোরহান উদ্দিন থাকেন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবার শাহজাহানপুর রেলওয়ের মাঠ ইজারা নেওয়া হয়। কিন্তু গরু মাঠ ছাড়িয়ে চলে যায় প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে। গত বছর বাসার সিঁড়ির নিচেও গরু বাঁধা ছিল। সেখানে গরুর মল-মূত্রের স্তূপ হয়ে যায়। জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে চলা-ফেরা করা যায় না। আমরা বাজার বা নিত্যপণ্যের কেনাটাকাও করতে পারিনি।

মাহবুব নামে অপর এক বাসিন্দা রেলওয়ের কর্মচারী। তিনি বলেন, ঈদের আগে সবার ছুটি থাকলেও আমাদের ছুটি থাকে না। কিন্তু অফিসে আমাকে খালি পায়ে যেতে হয়। পোশাকে গরুর গোবর ছিটকে লাগে। অফিসে গিয়ে হাত-পা পরিষ্কার করে ডিউটি করতে হয়। এবার আরও ভয়াবহ হতে পারে।

আরও পড়ুন: ক্রেতা মিলছে না বড় গরুর, ব্যাপারীদের মাথায় হাত

যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় হাট ইজারা করা হলেও সেখানে কোনো উন্মুক্ত জায়গা নেই। এই এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের দুপাশেই পশুর হাট বসছে। এতে দূরপাল্লার যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, যেসব এলাকায় হাট ইজারা দেওয়া আছে, সেখানে উন্মুক্ত জায়গা আছে। তবে ঈদের আগমুর্হূতে হাটগুলোতে চাপ বেড়ে যায়। হাটে শৃঙ্খলা রাখতে আমাদের মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। নাগরিকদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

উচ্চ আদালতে রিটরাস্তায় বা মহাসড়কে গরুর হাট না বসিয়ে খোলা জায়গায় বসানোর নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে গত ৫ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছিলেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রিটে স্থানীয় সরকার সচিব, ধর্ম সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই মেয়রকে বিবাদী করা হয়েছে। তবে ২২ জুন পর্যন্ত আদালতে এই রিটের শুনানি হয়নি বলে জানিয়েছেন ইউনুছ আলী আকন্দ।

তিনি বলেন, রিট করার পর ঈদের আগে শুনানির তারিখ পাওয়া যায়নি। ঈদের পর এই রিটের শুনানি হবে।

ঈদের পর রিটের শুনানি হলে নাগরিকদের কী লাভ হবে, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।

এমএমএ/এএসএ/জিকেএস