সারারাত আমার বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ভোর সাড়ে তিনটায় বারডেম হাসপাতালে পৌঁছলাম। তখনও চারিদিকে অন্ধকার। বারডেমের সামনেই অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং করে ভেতরেই অপেক্ষা করছি। ভাইয়েরা ইমার্জেন্সিতে গেছেন। বাবার বয়স সত্তর বছর। গত ছয় বছর ধরে ডায়েবেটিক, কিডনিজনিত রোগে ভুগছেন। জেলা শহরে বাড়ি আমাদের। মা-বাবা সেখানেই থাকেন। কর্মের তাগিদে আমরা কেউ ঢাকা, কেউ খুলনায় থাকি।
Advertisement
হঠাৎ করেই গতকাল বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখানকার ডাক্তার দেখে বিভিন্ন টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট দেখে বললেন, ‘রোগীর অবস্থা ভালো নয়, উনি আর বেশি হলে তিন মাস বাঁচবেন।’ এ খবর বিদ্যুৎ গতিতে সবার কাছে পৌঁছে গেল। যখন খবর এলো; তখন রাত পৌনে এগারোটা। খুলনা থেকে যাওয়ার কোনো বাস নেই। সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। পরদিন খুব সকালেই আমি খুলনা থেকে ও আমার ভাই ঢাকা থেকে রওয়ানা দিলাম।
বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়, প্রতিবেশীদের আনাগোনা। বাড়িতে যে আসেন, তাকে দেখেই বাবা হাউমাউ করে কান্না করেন। কেউ সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পান না। কেউ লুকিয়ে, কেউ সামনেই চোখের জল মোছেন। রাত দশটায় অ্যাম্বুলেন্স আসে। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের ভিড়-কান্নাকাটি পেছনে ফেলে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই।
ভোর চারটায় ইমার্জেন্সিতে বাবাকে নিই। কেবিনের জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়। ভর্তি করানো হলো, সব ফর্মালিটি শেষ করতে এখনও কিছুক্ষণ লাগবে। ইমার্জেন্সির সামনে বসে আল্লাহকে ডাকছি। এ সময় একটি ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে এক নারীকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে আসেন। তিনি চির রুগ্ন, হাত-পা বাঁশের কঞ্চির মতো, চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে আছে, বেশ লম্বা কিন্তু অসুস্থতার কারণে নুয়ে আছেন।
Advertisement
ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুবই নিরীহ, ভীষণ ভয়ে মুখটা কেমন হয়ে আছে। ছেলেটি নারীকে ধরে আনছে। নারী তার সমস্ত শরীরের ভর ছেলেটির ওপর দিয়ে আছেন। ছেলেটির অনেক কষ্ট হচ্ছে, হাঁপাচ্ছে। তারপরও সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে। ছেলেটিকে দেখে এক নার্স ছুটে গেলেন, ‘কে হয় তোমার, মা?’‘জি আমার মা।’‘কী নাম তোমার? কী করো তুমি? বাসা কোথায়?’‘আমার নাম জ্যোতি, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। মালিবাগে থাকি আমরা।’‘তুমি একা কেন? তোমার বাবা কোথায়?’‘বাবা আমাদের সাথে থাকেন না।’নার্সটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্যোতির দিকে তাকালেন, ‘কখন থেকে এমন হয়েছে?’‘ঘণ্টাখানেক আগে কেমন জানি করছিল। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আম্মার গোঙানি শুনে ঘুম ভেঙে যায়। কী করবো, কী করা উচিত, কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পাশের রুমের আঙ্কেলকে ডেকে বললাম। তিনি একটা সিএনজি ডেকে দিয়ে বললেন, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে।’
কথা বলতে বলতেই নার্সটা হাতের ইশারায় অন্য দুজন নার্সকে ডাকলেন। তারা দ্রুত ধরাধরি করে নারীকে ইমার্জেন্সির বেডে শুইয়ে দিলেন। মিনিটখানেকের মধ্যে বিভিন্ন মেশিনপত্র তারা শরীরে সেট করে দিলেন। দ্রুত স্যালাইন দিলেন। একের পর এক ইনজেকশন দিলেন। নার্সটি রুম থেকে বেরিয়ে ছেলেটিকে বলল, ‘জ্যোতি তোমার বাবা কোথায়, আত্মীয়-স্বজন কে আছেন? সবাইকে খবর দাও।’নার্সটির নাম নাজমা, তার বুকের ওপর ব্যাচে লেখা আছে। ছেলেটি নার্সকে বলল, ‘আন্টি আম্মার কী হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?’নাজমা কিছু বললেন না। দ্রুত ডিউটি ডাক্তারকে ডাকলেন। সেখান থেকে কয়েকজন ডাক্তারকে ফোন দিলেন। বললেন, ‘স্যার রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। পালস পাচ্ছি খুব ধীরে। সুগার নেমে হাইপো। দ্রুত ইমার্জেন্সিতে আসবেন প্লিজ।’
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সিনিয়র ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে এলেন। জ্যোতি একবার উঁকি দিয়ে রুমের ভেতর মাকে দেখলো। তারপর সহ্য করতে না পেরে আমার পাশের সিটে বসে শব্দহীন কাঁদতে লাগলো। তার চোখে যেন ঘন বরর্ষা। কোনো মতেই বর্ষণ কমে না। জ্যোতি ফোন বের করে কাকে যেন কল দিলো। যাকে কল দিচ্ছে, সে হয়তো এই ভোরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পর কল রিসিভ করলো। ‘আব্বা, আব্বা আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসেন। আব্বা, আমার আম্মা মনে হয় বাঁচবে না আব্বা। আব্বা, আমার যে আম্মা ছাড়া আর কেউ নেই। ও আব্বা, একবার আসেন। আব্বা, আপনার পায়ে পড়ি। আব্বা,ও আব্বা আপনি তো সেই ছোটবেলায় আমাকে আর আম্মাকে ফেলে চলে গেছেন। আম্মা না থাকলে আমার কী হবে আব্বা? আব্বা অনেক টাকা লাগবে। আপনি টাকা নিয়ে আসেন আব্বা। আমি কাজ করে আপনার সব টাকা পরিশোধ করে দেবো।’ জ্যোতি নিজেই কথা বলে যাচ্ছে। ওপাশের ব্যাক্তিকে সে কোনো কথাই বলতে দিচ্ছে না।
আমি অনাধিকার চর্চা করলাম। জ্যোতির কাছে থেকে ফোনটা নিয়ে নিলাম। তারপর ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে সব খুলে বললাম। আমার দেখা সবটা বললাম। রোগীর অবস্থা ভালো নয়, সেটা জানালাম। তাকে দ্রুত বারডেমে আসতে বললাম। তিনি বললেন, তার আসতে বিশ মিনিট সময় লাগবে।
Advertisement
জ্যোতির ফোনের কথা শুনে বুঝলাম, তার বাবা অনেক আগেই জ্যোতি আর তার মাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তারপর জ্যোতিকে বললাম, ‘ভাই, তোমার নানা, নানি, মামাদের ফোন দাও। তাদের জানাও।’জ্যোতির চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। তার চোখের পানি মুছে দিলাম, ‘তুমি শান্ত হও। ধৈর্য ধরো। তুমি সবাইকে কল দাও।’জ্যোতি তার মামার কাছে কল দিলো। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হলো। ‘মামা ও মামা, আম্মার অবস্থা ভালো না।’ জ্যোতি কান্না করতে লাগলো। আর কোনো কথায বলতে পারলো না। আমি আবারও ফোনটা নিয়ে কথা বললাম। জ্যোতির মামাকে সব জানালাম। এর মধ্যেই সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, রোগীকে নিয়ে ডাক্তার আর নার্সদের অস্থিরতা। রোগীকে বাঁচানোর জন্য তাদের চেষ্টা, তাদের ছোটাছুটি। এ সময় নাজমা নামের নার্সটি দ্রুত বেরিয়ে এসে ইন্টারকমে কল দিয়ে আইসিইউতে দ্রুত বেড রেডি করতে বললেন। ওয়ার্ড বয়কে ডেকে দ্রুত স্ট্রেচার আনতে বললেন।জ্যোতিকে দেখে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘দোয়া করো বাবা, মা নিশ্চয়ই দ্রুত ভালো হয়ে যাবেন।’আমি তখন এক ফাঁকে ওই রুমের পর্দা আস্তে করে সরিয়ে দেখলাম, রোগীর পালস ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, ‘আর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’ওয়ার্ড বয় স্ট্রেচার নিয়ে এসেছে। জ্যোতির মাকে স্ট্রেচারে তুলে আইসিইউতে নেওয়া হলো।
ভোর পাঁচটা। এরই মধ্যে আমার বাবার ভর্তির সব ফর্মালিটি শেষ হয়ে যায়। আরেকটি ওয়ার্ড বয় স্ট্রেচারে করে বাবাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। আমার মা, ভাইয়েরা বাবার সাথে গেলেন। আমার মা আমাকে জ্যোতির কাছেই থাকতে বললেন। আমি জ্যোতির পাশেই থাকলাম। জ্যোতিকে কিছুই জানালাম না। জ্যোতিকে সাথে নিয়ে আইসিইউয়ের সামনে গেলাম। জ্যোতি যেন বরফ হয়ে গেছে। ওর পুরো শরীর শীতল হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে আইসিসিইউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
পাঁচ মিনিট পর নাজমা বেরিয়ে এলেন। জ্যোতির মাথায় হাত রাখলেন, ‘বাবাকে, মামাদের খবর দাও। তাদের আসতে বলো।’জ্যোতি শক্ত হয়ে বসে রইল। যেন একটা কাঁঠের পুতুল।
ত্রিশ মিনিট পরই একজন ভদ্রলোক এলেন। তখন সাদা চাদরে ঢাকা লাশটার হাত ধরে জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোকটি জ্যোতির কাঁধে হাত রাখেন। জ্যোতির কোনোদিকে খেয়াল নেই। মৃত মায়ের হীম শীতল হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। যতই বাঁধা আসুক কিছুতেই এ হাত ছাড়বে না সে।
কিছুক্ষণ পর জ্যোতির দুই মামা, মামি, মামাতো ভাই আসে। সবাই কান্নাকাটি করে। জ্যোতি অবাক দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হসপিটালের সব ফর্মালিটি শেষ করেন জ্যোতির বাবা। লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। জ্যোতি কিছুতেই মায়ের হাত ছাড়ে না। এবার জ্যোতির বাবা ছেলের সামনে দাঁড়ান, ‘বাবা, এমন করে না। মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে তো।’ঝাটকা দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে জ্যোতি বাবার দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে যেন উল্কা ঝরে পড়ছে। ‘এখন আপনি এসেছেন আমার মায়ের আত্মার কষ্টের কথা বলতে। এখন আপনি আমার মায়ের আত্মার কষ্টের কথা ভাবছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? সেই আট বছর বয়সে আমাকে আর মাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। অফিসের কলিগকে বিয়ে করলেন। আম্মা আমাকে ফেলে দেননি। প্রথম প্রথম মাসে মাসে কিছু কিছু টাকা দিতেন। কয়েক মাস পরে সেটাও বন্ধ করে দিলেন। নানা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দুই মাস না যেতেই আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো। পরের ছেলের দায়িত্ব মামারা নিতে পারবেন না। দুইজন মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবেন না তারা।
পথে বেরিয়ে কই যাবো, কী করবো; কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি মা। মায়ের এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে উঠি। সেই আঙ্কেল কিছু টাকা দেন। তাদের বাড়ির পাশে ঘর ভাড়া নিয়ে থেকেছি। অল্প শিক্ষিত মা বস্তির বাচ্চাদের টিউশনি করিয়ে আর দুপুর-রাতে রান্না করে কয়েকজনকে খাইয়ে যে কয় টাকা পেতেন, তা দিয়ে ঘর ভাড়া পরিশোধ করে মা-ছেলের বিশ দিনও যেত না।
কতদিন আমরা না খেয়ে কাটিয়েছি। কতদিন আপনার কাছে গিয়েছি কয়টা টাকার জন্য। মাঝে মাঝে আপনি সামান্য কিছু দিয়েছেন। বেশিরভাগ সময় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার মাকে। আম্মা দিন দিন অসুস্থ হতে থাকেন। তার শরীরে নানাবিধ অসুখ বাসা বাঁধে। কী দোষ ছিল আমার মায়ের? কত কষ্ট করতে হলো তাকে। কই, তখন তো তার কথা চিন্তা করেননি।এখন তার কথা চিন্তা করছেন। তার আত্মার কষ্টের কথা ভাবছেন।
আব্বা আপনি আমার আম্মাকে তিলে তিলে খুন করেছেন। তাকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলেছেন আপনি। আমি এখন কই যাবো আব্বা? আমার তো আর কেউ থাকলো না। আমাকে কে দেখবে? আম্মা ও আম্মা, তুমি এত নিষ্ঠুর হলে কেন আম্মা? তুমি একবারও আমার কথা ভাবলে না আম্মা।
আম্মা গো, আমি এখন কার কাছে থাকবো আম্মা? ও আম্মা আম্মা, আমাকে ছেড়ে কেমন করে থাকবা তুমি?’
নাজমা ছুটে চলে আসেন। জ্যোতিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরেন। ‘কাঁদিসনে বাবা কাঁদিসনে। এভাবে যে কাঁদতে নেই।’ নাজমা জ্যোতিকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
কে বলেছে মরা মানুষ দেখতে দেখতে ডাক্তার-নার্সদের মন পাষাণ হয়ে গেছে। এই যে নাজমা কাঁদছেন। দাঁড়িয়ে থাকা সবাই চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। জ্যোতির মামা-মামিরা দূরে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে। তারা যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। জ্যোতির বাবা লাশের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন একটা কাঁঠের পুতুল।
ভোর ছয়টা। সব অন্ধকার কেটে আলো ফুটেছে। আর এদিকে নিভে গেলো একটা জীবন। জ্যোতির মাকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি জ্যোতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা কিশোর তার সবচেয়ে প্রিয়জনকে হারালো। তার মাথার ওপরের বটগাছটা নদীর অতলে তলিয়ে গেলো কিছু সময়ের ব্যবধানে।আজকের ভোরটা সেই কিশোরের জন্য কতটা কষ্টকর, তা কেউ বুঝতে পারবে না। আলোকিত ভোর কিন্তু কিশোরটির সামনে ঘোর অমাবস্যা।
দশ দিন পর বাবাকে রিলিজ দেওয়া হলো। তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। বাবাকে জেলা শহরের ডাক্তার ভুল ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। ভুল রিপোর্ট এসেছিলো। তবে এখানকার ডাক্তার সাবধানে থাকতে বললেন। নিয়ম মেনে চলতে বললেন। আমরা হাসিমুখে বাড়ি ফিরলাম। বাবা আরও তিন বছর বেঁচে রইলেন। তারপর দুই মাস কোমায় থেকে একদিন খুব সকালে চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে।
তারপর কেটে গেলো ছয়টা বছর। আমি এখন ঢাকায় থাকি। অফিস থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। এক কাপ কফি বানিয়ে বেলকনিতে বসেছি। এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। মেসেঞ্জারে কে একজন অপরিচিত ব্যক্তি কল দিয়েছেন। অনীহা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করি।‘হ্যালো।’‘লিজা আপা বলছেন?’‘জি বলছি। আপনি কে বলছেন?’‘আপা ভালো আছেন?’‘জি ভালো আছি। কে বলছেন বলবেন প্লিজ?’‘লিজা আপা, আমি জ্যোতি।’‘জ্যোতি? কোন জ্যোতি?’‘ভুলেই গেছো আপা?’দশ সেকেন্ডের মধ্যে মনে পড়ে গেলো। একটা চিৎকার দিতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। ‘জ্যোতি, কেমন আছো তুমি? কোথায় আছো? কী করো এখন? এতদিন পর মনে পড়লো আমাকে?’‘আপা একটু থামো। একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো কেমন করে? আমি এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। এখানকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলাম। আজ আমার কনভোকেশন ছিল। তোমাকে আজ ফেসবুকের মাধ্যমে খুঁজে পেলাম। ভালো করে তোমার প্রোফাইল চেক করে দেখলাম, এটা তুমিই। দেখলাম তুমি আনলাইনে আছো। তাই আর দেরী না করে কল দিলাম।’‘বাহ, আলহামদুল্লিলাহ। কিন্তু কেমনে কী? কীভাবে সব হলো?’‘আপা, তোমার নাজমা আন্টির কথা মনে আছে?’‘হুম, নার্স নাজমা তো? বারডেমের?’‘জি, আম্মা চলে যাওয়ার পর তিনি আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি আমাকে লেখাপড়া শেখান। অস্ট্রেলিয়ায় পাঠান। তিনি আমার আরেক মা। মাকে হারিয়ে আরেক মাকে পেলাম। সেই মা আমাকে বুকে টেনে নেন। আজ ভোর ঠিক ছয়টায় আমার সেই মা-ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আপা। আমার পৃথিবী আবারও অন্ধকারে ছেঁয়ে গেলো। আমার ভোরগুলো কেমন জানি। অন্যরকম। সব অন্ধকারে আচ্ছন্ন।’
আমি আমার ভোরটা দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আলো ফুটছে।
এসইউ/জেআইএম