পদ্মা সেতু চালুর এক বছরের মাথায় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌপথে যাত্রীর পাশাপাশি লঞ্চের সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে প্রতিদিন লঞ্চগুলোতে অর্ধেকেরও বেশি কেবিন খালি যাচ্ছে। বিলাসবহুল অনেক লঞ্চ ঘাটে অলস পড়ে আছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও ভাড়া কমিয়েও পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছে না লঞ্চগুলো। ফলে বদলেছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের চিরচেনা দৃশ্য।
Advertisement
একসময় ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের লঞ্চের একটি কেবিনের টিকিট ছিল সোনার হরিণ। পদ্মা সেতু চালুর পর সেই চিত্র পাল্টে গেছে। মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকা-বরিশাল যাতায়াতের জন্য সড়ক পথকেই বেছে নিচ্ছেন যাত্রীরা। ফলে সড়কপথে যাতায়াতে বিপ্লব এসেছে।
বরিশাল নদীবন্দর ঘুরে দেখা যায়, লঞ্চঘাটের সেই চিরচেনা রূপ বদলে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করা সব রুটের লঞ্চের যাত্রী কমেছে। লঞ্চগুলো এখন সারি বেঁধে ঘাটে নোঙর করা থাকে।
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটসহ দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে বেশি বিপাকে পড়েছে বরিশাল-ঢাকা, পটুয়াখালী-ঢাকা, আমতলী-ঢাকা, ঝালকাঠি-ঢাকা এবং কলাপাড়া-ঢাকা রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো।
Advertisement
এছাড়া হিজলা, গৌরনদী, হুলারহাট, ভাণ্ডারিয়া, বরগুনাসহ অন্তত ২০টি নৌরুটে মিলছে না যাত্রী। ঢাকা-বরিশাল রুটে দিনের বেলা চলাচল করা ওয়াটার বাস গ্রিনলাইন, অ্যাডভেঞ্চার-৫ আর এমভি টাইপের লঞ্চ রাজারহাট-সির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে আগেই।
নদীবন্দর সূত্রে জানা যায়, বরিশাল তথা দক্ষিণের অন্তত ২০টি নৌরুটের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ। টানা লোকসানের কারণে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এসব রুটে চলাচলকারী অন্তত ৩০টি লঞ্চ। সেই সঙ্গে চলছে একের পর এক নৌরুট বন্ধের প্রক্রিয়া।
এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই লঞ্চ ব্যবসায় ধস নামবে বলে আশঙ্কা করছেন লঞ্চ মালিকরা। তারা বলছেন, একবছর ধরেই লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়েই চলতে হচ্ছে। তবে কতদিন এভাবে টিকে থাকা সম্ভব? পরিস্থিতি এমন যে, প্রায় প্রতি রাউন্ড ট্রিপে আকারভেদে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিচ্ছে লঞ্চগুলো।
কথা হয় ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি কীর্তনখোলার মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একবার ঘুরে এলেই দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এটা একদিন কিংবা দুদিন মানা যায়। কিন্তু একটানা হলে কি সম্ভব? আমরা তো আর বাড়ি-জমি বিক্রি করে লঞ্চ চালাবো না।’
Advertisement
শুধু ফেরদৌসই নন, হতাশ দক্ষিণাঞ্চলের অন্য লঞ্চ মালিকরাও। লাগাতার যাত্রী সংকটে চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। অঘোষিত রোটেশন করেও টেকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, ব্যবসা পাল্টে ফেলার কথা ভাবছেন অনেকে।
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি সুরভী লঞ্চের পরিচালক রেজিন-উল কবির বলেন, ‘প্রায় সব লঞ্চেই ৬০ শতাংশ কেবিন এবং ৫০ শতাংশ ডেক খালি থাকছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। নতুন রেটে ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৪৫৭ টাকা হলেও আমরা নিচ্ছি ৪০০ টাকা বা তারও কম। এছাড়া সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়ার তুলনায় অনেক কম নিলেও মিলছে না যাত্রী।’
ঢাকা-বরিশাল রুটের অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার পর এখাতে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে কর্মচারী বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো রয়েছেই। রাউন্ড ট্রিপে যদি ৭০ শতাংশ কেবিন এবং ৬০ শতাংশ ডেক পরিপূর্ণ হয় তাহলেও লোকসান এড়িয়ে সমান সমান থাকতে পারি আমরা। কিন্তু এখন তো বলতে গেলে খালি লঞ্চ চালাতে হচ্ছে। প্রতিবার লঞ্চ বরিশাল ঘুরে ঢাকা এলেই হিসাবের খাতায় যোগ হয় লাখ টাকার লোকসান। এভাবে লোকসান দিয়ে তো লঞ্চ চালানো যাবে না।’
ঢাকা-বরিশাল রুটের পারাবত নেভিগেশনের মালিক শহিদুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মানুষ এখন আর লঞ্চে উঠছে না। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সব রুটে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে এ রুটে চলাচলকারী ৬০-৭০টি লঞ্চ।’
তিনি বলেন, একেকটি লঞ্চ বানাতে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ হয়। সে হিসাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিনিয়োগের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে কীর্তনখোলা, সুরভী, সুন্দরবন এবং অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির একটি করে এবং পারাবত ও টিপুর দুটি করে লঞ্চ বন্ধ। টানা লোকসান সামাল দিতে না পেরে এসব লঞ্চ বসিয়ে রেখেছেন মালিকরা।
কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় সড়কপথের যানবাহন চললেও বছরজুড়ে বন্ধ রাখা হয় লঞ্চ। তখনই ১২টা বেজে গেছে আমাদের। পরে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি মিললেও বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অনুমতি মেলেনি। এই ধাক্কা সামলে আমরা যখন টিকে থাকার লড়াই করছি ঠিক তখনই এলো পদ্মা সেতু চালুর পর সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধাক্কা। মানুষ এখন আর লঞ্চে উঠছে না, যা পরিস্থিতি তাতে লঞ্চ ঘাটে বেঁধে রাখা ছাড়া উপায় নেই।’
এসআর/এমএস