তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট, করতোয়া নদীবেষ্টিত দেশের উত্তরের জেলা গাইবান্ধা। অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো নদীভাঙনও এখানকার একটি বড় বিপর্যয়। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। নদীর বুকে জেগে ওঠা প্রায় শতবর্ষী স্থায়ী চরগুলোও ভেঙে নদীর পেটে চলে যাচ্ছে। ভাঙনে বসতবাড়ি, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ভবনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাই নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙনের কবলে পড়ে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে বদলে গেছে চরাঞ্চলের মানচিত্র। ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব নদীপাড়ের পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত মৌসুমি ত্রাণ ছাড়া আর তেমন কোনো স্থায়ী সমাধান পাননি। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এ জেলার ১৬৫ চরের লক্ষাধিক মানুষের সাজানো সংসার নিমিষেই তছনছ হয়ে যায়। সব হারিয়ে বারবার বদলাতে হয় ঠিকানা।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর নদীভাঙনে গাইবান্ধা, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার ভাঙনে স্থানান্তরিত হয় প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ছয় হাজার হেক্টর আবাদি জমি হয় অনাবাদি। এতে ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পদ ও অবকাঠামোর। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনা।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চর মাদারীপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম। বয়স ৫৫ ছুঁই ছুঁই। বাপ-দাদার সহায়-সম্পত্তির কমতি ছিল না। ৩০ বিঘা আবাদি জমির ফসল ঘরে তুলতেন তারা। তার জন্মের পরে থেকেই ১৫ বার তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়েছেন। এতে পরিবারটি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়েছে। আবাদি জমি নদীর পেটে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন যায়গায় শ্রম বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করছেন। তাদের মতো ভাঙনের কবলে চর মাদারীপাড়া, পাড়া সাদুয়া, লখিয়ার পাড়া, কাশিমবাজার, কারেন্ট বাজার, চর চরিতাবাড়ী, রাঘবের চরের হাজার হাজার মানুষ বারবার ঠিকানা বদলিয়েছেন।
Advertisement
একই চিত্র জেলার ফুলছড়ি উপজেলার বাজে ফুলছড়ি চরের। প্রায় শত বছর আগে গড়ে উঠেছে এই চর গ্রামটি। কিন্তু গত তিন বছরে যমুনার ভাঙনে বিলীনের পথে এই চরগ্রাম। এরইমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেশ কয়েকটি অবকাঠামো। গত দুই বছরে বসতভিটা হারিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে বাজে ফুলছড়ি, পিপুলিয়া, টেংরাকান্দি, পারুল চরের অন্ততপক্ষে পাঁচ হাজার পরিবার।
১৯৯৩ সালে গাইবান্ধা সদর উপজেলার চর কুন্দেরপাড়া জেগে ওঠে। এরপর বসতি থেকে শুরু করে, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ক্লিনিক, আশ্রয়কেন্দ্র, হাটবাজার স্থাপিত হয়। বিদ্যুৎ সুবিধাও পায় এই এলাকার মানুষজন। কিন্তু ৩০ বছরের স্থায়ী এই চরটিও নদীভাঙনে প্রায় বিলীন হতে চলেছে। ক্রমাগত ভাঙন চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চরটির স্থায়ী ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকরী স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
হরিপুর ইউনিয়নের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল খালেক বলেন, স্থায়ী পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাড়ছে নদীভাঙন। প্রতিবছর নদীতে সব হারিয়ে বারবার ঠিকানা বদলাতে হয়। গত কয়েক বছরে নদী ভাঙনে আমরা সব হারিয়েছি। আমরা এখন ত্রাণ চাই না। চাই ভাঙনরোধে স্থায়ী সমাধান। সেইসঙ্গে বাপ-দাদার জমিতে নিশ্চিতে থাকতে চাই।
কুন্দেরপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, চর কুন্দেরপাড়ায় নাগরিক সুবিধার সবকিছুই ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরের ভাঙনে কুন্দেরপাড়া, খারজানি, বাটিকামারীসহ আরও কয়েকটি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়েছে। চরের একমাত্র নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে দুইবছরে দুইবার সরাতে হয়েছে।
Advertisement
হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে এলাকার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। গত তিন বছরে অনেক পরিবারের ফসলি জমিসহ বসতবাড়ি ভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা না নিলে চলতি বর্ষায় নদীগর্ভে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নদী শাসনে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
ফুলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান মণ্ডল বলেন, মেইনল্যান্ডের মতো চরাঞ্চলগুলোকে রক্ষা করতে অস্থায়ী ও স্থায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সরকারের টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হবে। স্থায়ী চর ভাঙন প্রতিরোধে টেকসই কর্মপরিকল্পনা চান গাইবান্ধার ভাঙন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন, চরের মানুষজনের জীবনমানের উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা নদীভাঙন। দীর্ঘদিনের স্থায়ী চরগুলো নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে। এতে করে চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। স্থায়ী চরগুলো রক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. মজিবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ভাঙন রোধে কাজ করা হচ্ছে। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেসব এলাকায় ভাঙন শুরু হবে সেই এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী কাজ করা হবে। বর্তমানে স্থায়ী কাজের কোনো পরিকল্পনা নেই।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. অলিউর রহমান বলেন, সরকার টেকসই উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করছে। চরের মানুষজনের জীবনমান উন্নয়নে টেকসই পরিকল্পনার প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, নদী ভাঙনরোধে সরকার দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, নদী ভাঙন রোধে বড় বড় প্রকল্প আনা হয়েছে। নদী রক্ষায় কিছু স্থায়ী বাঁধের কাজ হচ্ছে। কিছু ইমারজেন্সি ও আধাস্থায়ী কাজ হয়েছে। এই কাজগুলো সব সার্বজনীন উন্নয়ন কাজ। একটি জায়গায় বাঁধ হওয়ার পরে অন্য যায়গায় ভেঙে গেলে সেটিও উন্নয়ন কাঠামোকে আঘাত করে। পাশাপাশি বিদ্যমান বাঁধের কাজগুলো ইফেক্টেট হয়ে যায়। এছাড়া হরিপুরের কারেন্ট বাজার, পাড়াসাদুয়া, কাশিমবাজার এলাকা ও বৃহত্তর তিস্তা ব্রিজ রক্ষায় ফাঁকে ফাঁকে যে অংশগুলোতে বাঁধের কাজ বাকি আছে সেগুলো স্থায়ী বা আধাস্থায়ী কাজ করে নদী শাসন করতে পারলে এই অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হবে। এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের বিড়ম্বনা কমবে, ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে। আশা রাখি, এই এলাকার মানুষের দাবি প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আন্তরিকভাবে দেখে নদী রক্ষায় বাকি কাজটুকু করবেন।
গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, বর্তমান সরকার প্রত্যেক নাগরিকের জীবনমানের উন্নয়নে বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলোকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে। পাশাপাশি যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরগুলোকে ভাঙন থেকে রক্ষায় গবেষণা চলছে।
এমআরআর/এমএস