অর্থনীতি

আইন লঙ্ঘন করে হচ্ছে সরকারি সম্পত্তির বিমা

আইন মেনে করা হচ্ছে না বিভিন্ন সরকারি সম্পত্তির বিমা। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল), পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন সম্পত্তির পাশাপাশি রোড, কালভার্টসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি আইন লঙ্ঘন করে বিমা করার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।

Advertisement

সাধারণ বিমা করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দপ্তর ও প্রকল্পের সম্পদ আইন না মেনে বিমা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন। একই সঙ্গে বেসরকারি সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোতেও এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, সরকারি সম্পত্তি অথবা সরকারি সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো ঝুঁকি বা দায় সম্পর্কিত সব ধরনের নন-লাইফ বিমা (সাধারণ বিমা) ব্যবসা সাধারণ বিমা করপোরেশনে শতভাগ অবলিখন করতে হবে। অবলিখন করার পর ৫০ শতাংশ নিজের কাছে রেখে অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ বেসরকারি নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমান হারে বণ্টন করে দেবে সাধারণ বিমা করপোরেশন।

আরও পড়ুন>> বন্ধ হতে পারে এক ডজন বিমা কোম্পানির ব্যবসা

Advertisement

অর্থাৎ, সরকারি সম্পত্তির বিমা শুধু সাধারণ বিমা করপোরেশনে করা যাবে। সাধারণ বিমা করপোরেশনের বাইরে বেসরকারি কোনো বিমা কোম্পানিতে সরকারি সম্পত্তি বিমা করা যাবে না। আর সাধারণ বিমা করপোরেশন সরকারি সম্পত্তির বিমা গ্রহণ করে তার ৫০ শতাংশ নিজের কাছে রাখবে এবং বাকি ৫০ শতাংশ দেশে ব্যবসা করা অন্য সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমান হারে ভাগ করে দেবে।

আইনে এমন বিধান থাকলেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের সম্পত্তির বিমা সাধারণ বিমা করপোরেশনের বদলে সরাসরি বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে করা হয়েছে। ফলে বিমা খাতে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। এতে অন্য বিমা কোম্পানি সরকারিখাতের প্রাপ্য প্রিমিয়ামের অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ সাধারণ বিমা করপোরেশনের। আইন লঙ্ঘন করে করা এসব বিমা অবৈধ এবং ইস্যু করা যে কোনো বিমা বাতিল হবে বলেও জানিয়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশন।

এ বিষয়ে সম্প্রতি সাধারণ বিমা করপোরেশন থেকে দেশে ব্যবসা করা সব বেসরকারি সাধারণ বিমা কোম্পানিতে চিঠি দেওয়া হয়। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) কাছে লেখা এ চিঠিতে বলা হয়েছে, বিমা করপোরেশন আইন ২০১৯ অনুযায়ী সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিমাযোগ্য সম্পদের বিমাঝুঁকি সাধারণ বিমা করপোরেশনের মাধ্যমে অবলিখনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কতিপয় বেসরকারি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি বে-আইনিভাবে সরকারি সম্পদের বিমা অবলিখন করছে। এতে আইন লঙ্ঘন ছাড়াও সাধারণ বিমা করপোরেশনসহ অন্য বিমা কোম্পানি সরকারিখাতের প্রাপ্য প্রিমিয়ামের অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং বিমা শিল্পে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।

সরকারি সম্পত্তির ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। এর মধ্যে রয়েছে-

Advertisement

>> যে কোনো ধরনের স্থাবর অথবা অস্থাবর সম্পত্তি, যা সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কিংবা সংরক্ষণে রয়েছে এবং যার রক্ষণাবেক্ষণের আইনগত দায়িত্ব সরকারের।

>> সরকার অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বরাবর ন্যস্ত সম্পত্তি।

>> সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীন বা নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো কোম্পানি, খামার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, উদ্যোগ বা অন্য কোনো স্থাপনা অথবা যেগুলোতে সরকারের বা সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বা সরকার ও কোনো কোম্পানির যৌথ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা রয়েছে বা যাতে সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ওই রূপ আর্থিক সংশ্লেষ বা স্বার্থ রয়েছে বা কোনো কোম্পানির অর্থায়নে সরকারের গ্যারান্টি রয়েছে।

>> সরকারের গ্যারান্টিযুক্ত বৈদেশিক ঋণ বা আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত যে কোনো প্রকল্প।

>> সরকার নির্ধারিত অন্য কোনো সম্পত্তি।

সাধারণ বিমা করপোরেশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. হামিদুল হক সই করা চিঠিতে বিমা করপোরেশন আইন ২০১৯ পরিপালনের জন্য বেসরকারি বিমা কোম্পানির সরকারি বা সরকারের আর্থিক সংশ্লেষযুক্ত সম্পত্তির বিমা ঝুঁকি আবরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন>> যানবাহনের বিমা ফের বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ

সাধারণ বিমা করপোরেশনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) থেকেও এ বিষয়ে সব সাধারণ বিমা কোম্পানিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যার অনুলিপি পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছেও।

বিআইএর এই চিঠিতে বলা হয়েছে, আইন অনুসারে সাধারণ বিমা করপোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিমাযোগ্য সব সম্পদের বিমাঝুঁকি অবলিখনের আইনানুগ দায়িত্ব ও কর্তৃত্বপ্রাপ্ত একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। সাধারণ বিমা করপোরেশন ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সরকারি সম্পদের বিমাঝুঁকি গ্রহণ করার কোনো এখতিয়ার নেই। কোনো কোম্পানি তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকারি সম্পত্তি বিমাঝুঁকি অবলিখন করলে তা হবে সম্পূর্ণ বে-আইনি। আইনের দৃষ্টিতে সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

এতে বলা হয়েছে, কতিপয় নন-লাইফ বিমা কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকারি সম্পদের বিমা অবলিখন করার ফলে অন্য নন-লাইফ বিমা কোম্পানি সরকারিখাতের প্রাপ্য প্রিমিয়ামের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে বিমা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে, যা আদৌ কাম্য নয়।

সরকারি সম্পদের ঝুঁকি বা দায় সম্পর্কিত বিধি-বিধান সম্পূর্ণ মেনে বিমা ব্যবসা পরিচালনাসহ সরকারি সম্পত্তির কোনোরূপ বিমাঝুঁকি অবলিখন না করার জন্য চিঠিতে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, যে সব কোম্পানি অন্য বিমা কোম্পানির নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে শুধু তাদের কোম্পানিকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে সরকারি আইন ভঙ্গ করে সরকারি সম্পদের ওপর বিমা ব্যবসা করছেন, যা কোনোভাবেই যাথার্থ ও গ্রহণযোগ্য নয়।

আরও পড়ুন>> বাধ‌্যতামূলক হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি ভবনের বিমা

যোগাযোগ করা হলে সাধারণ বিমা করপোরেশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. হামিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আইন না মেনে সরকারি সম্পত্তির বিমা করার বিষয়টি আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে উদঘাটন করতে পারছি। উদঘাটনের পর আমরা কোম্পানিগুলোকে চিঠি লিখছি। একই সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, সড়ক ও জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি যেসব সংস্থার সম্পত্তি বিমা করা হয় তাদের আমরা চিঠি লিখছি।

তিনি বলেন, আমরা সড়ক ও জনপথের বিভিন্ন কাজ, ঢাকা মেট্রোরেল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের কাজ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন কাজ, বিভিন্ন রোড, কালভার্ট, সেতু, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ, বিভিন্ন সরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসার ভবন নির্মাণ কাজের বিমা সাধারণ বিমা করপোরেশনের করার কথা, সেটা করছে বেসরকারি বিমা কোম্পানি। সরকারি আইন অনুযায়ী যেটা আমাদের (সাধারণ বিমা করপোরেশন) করার কথা, সেটা অন্য কেউ করলে তো বৈধ না।

তিনি আরও বলেন, বিমা করপোরেশন আইন সঠিকভাবে সব দপ্তরে বিতরণ করা হয়নি অথবা নজরে আনা হয়নি অথবা কিছু অংশ নজরে থাকার পরও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। আমরা এ বিষয়ে সবাইকে অবগত ও সতর্ক করার কাজ করছি। সরকারি সম্পত্তির বিমা বেসরকারি কোম্পানিতে করা এমন দেড় কোটি টাকার মতো বিমা আমরা গত প্রান্তিকে আদায় করতে সক্ষম হয়েছি।

বিআইএ’র প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ পাভেল জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি সম্পত্তির বিমা বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে খুব বেশি আকারে হয় না। কোনো কোনো কোম্পানি হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে করে, অনেকে আবার অনিচ্ছাকৃতভাবে বোঝে না এটা সরকারি নাকি বেসরকারি সম্পত্তি। কারণ সরকারি কাজগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ঠিকাদারের মাধ্যমে হয়। তখন দেখা যায় কোম্পানিগুলোর ইনচার্জ বা যারা ব্যবসা প্রকিউর করে তারা না বুঝেই করে ফেলে। আবার অনেক সময় জেনেশুনেই করে।

তিনি বলেন, জেনেশুনে করুক বা না জেনেশুনে করুক যেটা আইনসিদ্ধ না সেটা বে-আইনি। তার মানে এই টাকা সাধারণ বিমা করপোরেশনকে ফেরত দিতে হবে। কারণ ব্যবসাটা সাধারণ বিমা করপোরেশনের করার কথা। এজন্য আমরা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে টাকা ফেরত দিতে বলি। তারপও যদি কোনো কোম্পানি টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে, সেক্ষেত্রে এটা অন্যায়।

এমএএস/এএসএ/এমএস