পাহাড় কন্যাখ্যাত প্রাকৃতিক ভূস্বর্গের অপার লীলাভূমি বান্দরবান। অন্যবছর ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় মুখর থাকতো জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো। আর টানা সরকারি ছুটি পড়লে এই সংখ্যা বাড়তো কয়েকগুণ। ফলে আগত পর্যটকদের সেবায় জেলায় গড়ে ওঠে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ। পর্যটনখাতে যুক্ত হয়ে জীবিকানির্বাহ করছেন জেলার ১০ হাজারেরও বেশি লোকজন।
Advertisement
তবে এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। ঈদুল আজহার আর কয়েকদিন বাকি থাকলেও এ ছুটিতে আশানুরূপ বুকিং না পেয়ে হতাশায় দিন কাটছে বান্দরবানের পর্যটন ব্যবসায়ীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে জেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে সশস্ত্র সংঘটনগুলোর আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। এতে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর রুমা ও রোয়াংছড়িতে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন। এই নিষেধাজ্ঞা কয়েক দফায় বাড়িয়ে রুমা-রোয়াংছড়ির সঙ্গে আলীকদম ও থানচিতেও আরোপ করা হয়। পরে আলীকদম উপজেলা থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে এখনো বহাল আছে।
এরইমধ্যে সন্ত্রাস দমনে নিরাপত্তাবাহিনীর চলমান অভিযানে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আট মাসেরও বেশি সময় ধরে পর্যটকদের নিরাপত্তাজনিত কারণে জেলার তিন উপজেলা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকায় পর্যটকরা বান্দরবান ভ্রমণে বিরত থাকছেন। ফলে আশানুরূপ পর্যটক না পাওয়ায় জেলার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই ক্ষতি পোষাতে না পেরে কেউ কেউ হোটেল বিক্রির জন্য গ্রাহক খুঁজছেন।
Advertisement
হোটেল হিল্টনের ম্যানেজার আক্কাস উদ্দিন জানান, অন্যবছর সাধারণ ছুটির দিনেও হোটেলের অধিকাংশ কক্ষ এবং বিশেষ ছুটির সময় অন্তত ১৫ দিন আগে হোটেলের সব কক্ষ বুকিং হয়ে যেত। তবে এবার ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটিতেও তেমন পর্যটকের সাড়া পাওয়া যায়নি। মোট হোটেল কক্ষের ১০ শতাংশও বুকিং হয়নি। ফলে দীর্ঘ আট মাস ধরে গড়ে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন হোটেল মালিক।
হোটেল হিলভিউয়ের ম্যানেজার তৌহিদ পারভেজ বলেন, সারাবছর ধরে এই ঈদ মৌসুমের জন্য পর্যটন ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় থাকেন। অন্য বছর যেখানে ঈদের ১০-১৫ দিন আগে থেকে শতভাগ বুকিং হয়ে যেত, এবার আট শতাংশ হোটেল কক্ষও বুকিং হয়নি।
তিনি বলেন, জেলার তিন উপজেলায় টানা আট মাসেরও অধিক সময় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটকরা বান্দরবান ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হওয়ায় পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। দ্রুত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে জেলার পর্যটনশিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন তিনি। এছাড়া তার হোটেলের মালিক এখন গড়ে প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
হোটেল নীলাদ্রির মালিক সুজন দাশ জানান, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আট মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলার কয়েকটি উপজেলা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ক্ষতি পোষাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত হোটেলটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
Advertisement
বান্দরবান হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার জেলায় পর্যটকের উপস্থিতি কিছুটা কম। তবে বান্দরবান সদর, আলীকদম, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ভ্রমণে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এছাড়া বান্দরবান সদর ভ্রমণে পর্যটকদের জন্য আবাসিক হোটেলগুলোতে ক্ষেত্র বিশেষে ২০-৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বান্দরবান জিপ-মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি নাছিরুল আলম বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বান্দরবান ভ্রমণপ্রত্যাশীদের জন্য প্রত্যেক গাড়িতে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জাগো নিউজকে বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলা ভ্রমণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বান্দরবান সদর, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ভ্রমণে কোনো বিধিনিষেধ নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এবারের পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটিতে বান্দরবান ভ্রমণে আসা পর্যটকের জন্য নীলাচল ও মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রের প্রবেশ ফি ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে।
নয়ন চক্রবর্তী/এমআরআর/এমএস