পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে গরিব ও দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দের ভিজিএফ চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে দায়িত্বে থাকা ট্যাগ কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
Advertisement
১০ কেজি করে চাল বিতরণের কথা থাকলেও চেয়ারম্যানরা সাড়ে সাত থেকে সাড়ে আট কেজি দিচ্ছেন। পরিমাণে কম দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপকারভোগীরা।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২৩ জুন) সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার মাইজখাপন, মহিনন্দ, লতিবাবাদ ও রশিদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অসহায় মানুষের মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হচ্ছে। ট্যাগ অফিসারদের উপস্থিতিতে চাল বিতরণের কথা থাকলেও সেখানে তাদের কারও দেখা মেলেনি।
ডিজিটাল মেশিনে বা কাটাতে ওজন করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিকের বালতিতে করে। চাল পাওয়া কয়েকজনের চাল আবার ডিজিটাল মেশিনে মেপে দেখা গেছে, কোনোটিতে ৭ কেজি ৭৭০ গ্রাম, কোনোটিতে ৮ কেজি ১০০ গ্রাম, সর্বোচ্চ যেটি পাওয়া গেছে সেটির ওজন ৮ কেজি ৬৫০ গ্রাম।
Advertisement
তবে জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, তারা চেষ্টা করছেন ১০ কেজির যেন কম না হয়। এত মানুষের মধ্যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে; দুই-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। ৮ কেজি বা সাড়ে ৮ কেজি হওয়ার সুযোগ নেই। হয়তো দুই-একশ গ্রাম চাল কমবেশি থাকতে পারে। তাদের মধ্যেই আবার কেউ কেউ বলছেন, যাদেরটা আপনারা ওজন করেছেন তারা হয়তো নেওয়ার পথে অসাবধানতাবশত রাস্তায় কিছুটা ফেলে দিয়েছেন।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি ভিজিএফ কার্ডধারী ১০ কেজি করে চাল পাবেন। অথচ সদর উপজেলার এই চার ইউনিয়নের কোনোটিতেই কার্ডধারী একজন ব্যক্তি পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের কারও কাছেই জাতীয় পরিচয়পত্রও দেখা যায়নি। চাল নিতে আসা প্রত্যেকের হাতেই আছে ইউপি সদস্য বা চেয়ারম্যানদের দেওয়া বিশেষ টোকেন। চাল বুঝে পাওয়া ব্যক্তিদের কারও সইও নেওয়া হচ্ছে না সেখানে। ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে বসে আছেন চেয়ারম্যান, বাইরে বসে টিপসই নিচ্ছেন ইউপি সচিব। তারা কতজনকে স্লিপ দিয়েছেন তার কোনো হিসাবও নেই। এর ফলে প্রকৃত কার্ডধারীরা চাল না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা হারুন মিয়া। তিনিসহ তার এক আত্মীয়ের চাল নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির দিকে। এমন সময় ইউনিয়ন পরিষদের সামনের দোকানে তার চালের ব্যাগটি ওজন করে দেখা গেছে, সেটিতে রয়েছে ১৫ কেজি ৬৭০ গ্রাম। ব্যাগে তো ২০ কেজি হওয়ার কথা শুনে হারুন মিয়া বললেন, যেটুকু পেয়েছি সেটা নিয়েই বাড়ি যেতে হবে। প্রতিবাদ করলে পরেরবার নাম বাদ যেতে পারে, তাই কিছুই বলিনি।
একই ইউনিয়নের বেত্রাহাটি গ্রামের বাসিন্দা চুন্নু মিয়ার চালের ব্যাগের ওজন করে দেখা গেছে ৮ কেজি ১৭০ গ্রাম। তিনি জানান, ভেতরে ওজন মাপার কোনো যন্ত্র নেই। চাল দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিকের বালতিতে করে। অনুমানে যতটুকু হয় সেটুকু দিচ্ছেন। কম-বেশি নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগই নেই।
Advertisement
মহিনন্দ ইউনিয়নের বাদে শোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা উবাইদুল হক বলেন, সরকার আমাদের জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছে। আর তারা ৮ কেজি করে চাল দিচ্ছে। আমরা ২ কেজি করে চাল কম নেব কেন? আমাদের ১০ কেজি করে চাল বুঝিয়ে দিক।
এই ইউনিয়নের দরিয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা আছমা খাতুন বলেন, চাল আনতে ভেতরে গিয়ে দেখি ওজন না মেপে অনুমানের ওপর বালতিতে করে চাল দিচ্ছে। কম-বেশি বোঝার সুযোগ নেই। বাইরে এসে মেপে দেখি দেড় কেজি কম।
রশিদাবাদ ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা জানান, শুক্রবার সকালে আমার ও আমার চাচার দুটি কার্ডের চাল নিতে ইউনিয়ন পরিষদে আসি। পরে চাল তুলে বাইরে গিয়ে ওজন করে দেখি ১০ কেজি করে দেওয়ার কথা থাকলেও ৮ কেজি ১০০ গ্রাম করে সর্বমোট ১৬ কেজি ২০০ গ্রাম হয়েছে। তারা চাল ওজন না করে বালতিতে করে চাল দিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, ইউপি সচিব রেজাউল করিমের উপস্থিতিতে প্লাস্টিকের বালতিতে করে চাল মেপে দিচ্ছেন সুলতান আহমেদ নামে এক গ্রাম পুলিশ। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ওরফে তারু মিয়ার ঘনিষ্ঠ কর্মী ফুল মিয়া। এসময় চাল পাওয়া কয়েকজনের ব্যাগ ওজন করে দেখা গেছে, সাড়ে ৭ কেজি থেকে শুরু তরে ৮ কেজি বা সাড়ে ৮ কেজি চাল রয়েছে সেগুলোতে।
ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, এই কথা আমাকে না বলে চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করেন। একপর্যায়ে কৌশলে পালিয়ে যান তিনি। পরে চেয়ারম্যানকে ফোন করা হলে তিনি এসে জানান, অসুস্থ থাকায় সচিবকে দায়িত্ব দিয়ে বাড়িতে বিশ্রামে ছিলেন। তার ভাষ্য, দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এমন করবেন সেটা তিনি আশা করেননি। আপনার ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা ট্যাগ কর্মকর্তারা কোথায়, এমন প্রশ্নে নীরব ভূমিকা পালন করেন তিনি।
পরবর্তীতে সেখানকার ট্যাগ কর্মকর্তা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জহিরুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি ট্রেনিংয়ে আছেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, তার অনুপস্থিতিতে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নবী হোসেন ও দুইজন প্রাইমারি শিক্ষক দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে নবী হোসেন বা কোনো শিক্ষককে পাওয়া যায়নি।
একই চিত্র মহিনন্দ ইউনিয়ন পরিষদেরও। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে বসে বিভিন্ন ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশদের নিয়ে প্লাস্টিকের বালতিতে করে চাল দিচ্ছেন চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। ৮ কেজি থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ কেজি চাল দিচ্ছেন তিনিও। ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকেই কম দিচ্ছি না। হয়তো দুই-একটাতে সমস্যা হতে পারে। পরবর্তীতে তার উপস্থিতিতে কয়েকটি ব্যাগ ওজন করা হলে সবগুলোতেই কম পাওয়া যায়।
এই ইউনিয়নের ট্যাগ কর্মকর্তা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাঈদা রুবাইয়াত জানান, আগেরদিন যখন চাল বিতরণ করা হয়েছে তখন তাকে জানানো হয়নি। পরেরদিন তাকে জানানো হলেও সেদিন অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। চাল বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি দাবি করেন, তার উপস্থিতিতে যেদিন চাল বিতরণ করা হয়েছে তখন কোনো অনিয়ম হয়নি।
শুক্রবার বেলা ১১টায় লতিবাবাদ ইউনিয়ন পরিষদেও দেখা মেলে একই চিত্র। ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক একটি কক্ষে বসে ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশদের নিয়ে প্লাস্টিকের বালতিতে করে চাল দিচ্ছেন। বারান্দায় একটি টেবিলে বসে চাল নিতে আসা ব্যক্তিদের টিপসই নিচ্ছেন ইউপি সচিব দিলুয়ারা বেগম। ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাকের দাবি, পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে না বরং তালিকায় নাম থাকাদের বাইরেও বিভিন্ন অসহায়দের নিজের টাকায় সহযোগিতা করেন তিনি। ট্যাগ কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে চাল বিতরণের নিয়ম আছে কী না জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।
ইউনিয়নের ট্যাগ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক। তিনি উপজেলা বিআরডিবির প্রজেক্ট কর্মকর্তা। সরেজমিনে গিয়ে তাকেও পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তার ব্যবহার মোবাইলফোনে কল করা হলে ছুটে এসে বলেন, আপনারা আসার খানিকটা আগেই বাসায় গিয়েছিলাম।
আরও ভয়াবহ চিত্র রশিবাদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জুয়েল। বালতিতে করে তিনিও চাল বিতরণ করেছেন। ওজনে কম দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই তিনি বলেন, কম দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। ট্যাগ কর্মকর্তা কোথায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি সকালে এসে চলে গেছেন। ট্যাগ কর্মকর্তার নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওনার পদবি মনে নেই তবে মোবাইল নম্বর আছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি সদস্য জানান, চাল বিতরণের প্রথমদিন ক্ষণিকের জন্য ট্যাগ কর্মকর্তা এসেছিলেন, পরে আর আসেননি। উপজেলা দরিদ্র বিমোচন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম ভূইয়া এই ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাগ কর্মকর্তা। যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চাল বিতরণ করা হচ্ছে তিনি সেটি জানেনই না।
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী।
কিশোরগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসকে রাসেল/এমআরআর/জেআইএম