জাতীয়

‘ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে খেলা করছে’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন।

Advertisement

জামায়াত ও চলমান রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: দীর্ঘ এক দশক পর নির্বিঘ্নে সমাবেশ করলো জামায়াত। প্রতিহতের পরিবর্তে অনেকটাই পাহারার দায়িত্বে থাকলো পুলিশ। জামায়াতের উপস্থিতি ও কার্যক্রম নিয়ে আপনার অবশ্যই পর্যবেক্ষণ আছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: জামায়াত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন তাদের সহযোগীরাও আর তৎপরতা চালানোর বৈধতা রাখে না। উচ্চ আদালত থেকেও বলা হয়েছে জামায়াত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি সন্ত্রাসী সংগঠন।

Advertisement

আরও পড়ুন>> দু’একটি দল ভোটে অংশ না নিলে গণতন্ত্র বিলীন হয়ে যায় না

ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে খেলা করছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রমাণ করার চেষ্টা করছে কে বেশি ইসলাম প্রিয়। ইসলাম প্রিয়তার নামে তারা গদি দখলের চেষ্টা করছে মাত্র। জামায়াত নামের কালসাপ ফণা তুলছে মরণ কামড় দেওয়ার জন্য। আমরা দেখেছি, জামায়াত-শিবির কীভাবে মানুষের হাত-পায়ের রগ কেটেছে, মুক্তমনা মানুষদের হত্যা করেছে। জামায়াত নামের বিষবৃক্ষ লালন করছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর আগে বিএনপি করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মিলে এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে লালন করে চলছে।

জাগো নিউজ: সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য অন্যকে দায় দিচ্ছেন। বামপন্থিদের দায় নিয়ে কী বলবেন? তারাও ব্যর্থ কি না?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এই প্রশ্নে আমি বামপন্থিদের কার্যক্রমের প্রশংসা করতে চাই। কারণ তারা এই নীতিতে অন্যদিকে যায়নি। বামপন্থিরা অন্তত শিবির পরিবর্তন করেনি।

Advertisement

জাগো নিউজ: সিপিবি সম্পর্কে বললেন নাকি সাধারণ বামপন্থিদের ব্যাপারে বললেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি সাধারণপন্থিদের নিয়ে বলছি।

জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগ সকারের সঙ্গেও বাম দল আছে। ইসলামি দলও আছে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এটি অন্য প্রশ্ন। আমি বলছি, বামপন্থিরা সাধারণভাবে এই প্রশ্নে আপস করেনি। তারা বারবারই সাম্প্রদায়িক শক্তির ব্যাপারে সোচ্চার।

আরও পড়ুন>> ‘সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষকেই জাগতে হবে’

তবে আমাদেরও আত্মসমালোচলার বিষয় আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা বুর্জোয়া সরকারগুলোর বিরোধিতা করেছি বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রশ্নে বামপন্থিদের ত্রুটি রয়েছে। চেষ্টা করা হয়নি তা নয়। তবে সর্বাত্মক চেষ্টায় ত্রুটি ছিল।

চেতনা আসলে একসঙ্গে সব মানুষের মধ্যে বিকশিত হয় না। ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। অপ্রস্তুত থাকলেও নানা ঘাটতি নিয়ে আমাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর অসম্প্রাদায়িক ও মতাদর্শগত চেতনার যা করার কথা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে পারিনি। কিছু কিছু করতে পেরেছি বটে।

আরেকটি বিষয় সামনে আনা দরকার। অনেকেই মনে করেন সাম্প্রদায়িক শক্তি আগে নির্মূল হোক, ভাত-কাপড়ের বিষয়টি পরে। এটি একটি বিরাট ভ্রান্তি এবং আত্মঘাতীমূলক নীতি বলে মনে করি। ভাত-কাপড়ের লড়াই আর সাম্প্রদায়িক শক্তির লড়াই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। মানুষকে যদি ইহলৌকিক সমস্যা সমাধানের গণতান্ত্রিক পথ দেখাতে না পারি, তাহলে তারা অদৃষ্টবাদে আকৃষ্ট হবে। মানুষ সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। সাম্প্রদায়িক শক্তি সেই ঝুঁকে পড়া কাজে লাগায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বামপন্থিরা যোগ দিয়ে বলতে চাইলো, আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ করবো। পরে শ্রেণি সংগ্রাম, ভাত-কাপড়ের অধিকার নিশ্চিত করবো। এতে তারা দুই দিকটাই পরিত্যাগ করলো। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে কিছু কিছু বামরা দেশকে আরও সাম্প্রদায়িক করে তুলেছে। মানুষের মনোজগতে এখন সাম্প্রদায়িক চেতনা গেঁথে যাচ্ছে। এর দায় আওয়ামী লীগের যেমন, তেমনি সরকারের জোটের অন্য দলগুলোরও।

জাগো নিউজ: এই যে মানুষের মনে গেঁথে যাওয়ার কথা বলছেন, তাহলে সামনে কী অপেক্ষা করছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমরা রাজনীতির এক ফাঁদে পড়ে গেছি। অর্থনৈতিকভাবে লুটপাট করা ব্যক্তিরাই এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করছে। মিডিয়া থেকে শুরু করে সমাজের সবকিছু এই শক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। সাব গ্রুপ থাকলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি হচ্ছে প্রধান গ্রুপ। বাজার অর্থনীতি পুঁজি করে তারা লুটপাট করে চলছে। রাজনীতিকেও পণ্যে পরিণতি দিয়েছে। ভোগবাদই এখন মূল রাজনীতি। টাকা থাকলেই রাজনীতি দখল করা যায়।

আরও পড়ুন>> ‘নির্দলীয় সরকার ছিল বলেই চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল’

এ কারণেই জনশক্তির ওপর নির্ভর করতে পারছে না। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থেকে লুটপাট অব্যাহত রাখতে চায়।

জাগো নিউজ: বাঙালি মননে ইসলামি রাজনীতির কোনো বিকাশ দেখতে পাচ্ছেন কি না?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না। একজন মানুষের নানা আইডেন্টিটি থাকে। জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয়, লৈঙ্গিক, অঞ্চলগত, পেশাগত পরিচয় থাকে। এটি দোষের নয়। সব আত্মপরিচয়ের মধ্যে ভিত্তিমূলক হলো শ্রেণি আত্মপরিচয়। এই শ্রেণিগত আত্মপরিচয়টা কোনো সময় ওপরে উঠতে দেয় না শাসকশ্রেণি। সব সময় আড়াল করতে চায়। শ্রমশক্তিকে শোষণ করার ক্ষেত্রে সব শাসকই একনীতি। আবার সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ক্ষেত্রেও অসম্ভব মিল রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর। ধর্মীয় আত্মপরিচয়ে বিভক্তি হতে তারা নানা কায়দায় উসকে দেয়।

জাগো নিউজ: এই বিভাজনের কারণে ইসলামি দলগুলো এগিয়ে যাচ্ছে কি না? সম্প্রতি সিটি নির্বাচনগুলোই ইসলামি আন্দোলন নামের দলটির প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি তো আগেই বলেছি, মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক চেতনা ক্রমাগতভাবে প্রসারিত হচ্ছে। ভাত-কাপড়ের সমাধান না পেয়ে তারা কপালের (অদৃষ্ট) ওপর নির্ভর করতে চাইছে। এই চিন্তাই মানুষ দর্শন হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থন না পেলে এ ধরনের শক্তি কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। কে বেশি ইসলাম পছন্দ করে তার প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে আরও ভয়াবহতা তৈরি হবে।

সরকার ও প্রশাসনের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোট, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কে কত ভোট পাবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকলেও আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাগুলো অর্থের ওপর নির্ভর করছে। সব নির্বাচনেই টাকার খেলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে এর জন্য দোষ দিতে পারেন না। নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে এটি মানুষ আর বিশ্বাস করে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সব প্রশাসন নিজের অজান্তেই সরকারের প্রতি ঝুঁকে থাকে। এটিই এখন রাজনীতির সংস্কৃতি।

এ কারণেই তিন জোটের রূপরেখা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা করা হয়, তার ড্রাফট করেছিলাম আমি। সেখানে লিখেছিলাম, অন্তত তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। মজার বিষয় হলো শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উভয়ই লাইনটি কেটে দেন।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম