বছরজুড়েই মানুষ বিভিন্ন সময় তাকবির পড়েন। হজ ও কোরবানির মাস এলেই তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব হয়ে যায়। জিলহজ মাসের নির্ধারিত ৫ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। কিন্তু এ তাকবিরে তাশরিক কীভাবে এলো? এর গুরুত্বই বা কী?
Advertisement
হজ ও কোরবানির মাসে নির্ধারিত ৫ দিন ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। তাকবিরে তাশরিক আবশ্যক হওয়ার সূচনার ঘটনাও চমৎকার। এর গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং ফজিলতও অনেক বেশি। তাকবিরে তাশরিক যেভাবে শুরু হয়েছিল-
তাকবিরে তাশরিক এলো যেভাবে
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানির নির্দেশ পালনে জবাই করার জন্য মাটিতে শোয়ালেন, তখন আল্লাহ তাআলা হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামকে বেহেশত থেকে দুম্বা নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
Advertisement
হজরত ইসমাইলকে জবাই করার আগে যাতে দুম্বা নিয়ে পৌঁছাতে পারে সে জন্য হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম আকাশেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে থাকেন-
اَللهُ اَكْبَر – اَللهُ اَكْبَر (আল্লাহু আকবার; আল্লাহু আকবার) আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাকবিরের আওয়াজ শুনে কাপড় দ্বারা আবৃত চোখ খুলে দেখলেন হজরত জিবরিল আলাইহি সালামের আনিত দুম্বা ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে কোরবানি হয়ে যায়। তখন তিনি তাওহিদের কালেমা ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন এভাবে-
لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ اَللهُ اَكْبَر (লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার) অর্থাৎ আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আপনিই শ্রেষ্ঠ।
Advertisement
বাবার মুখে তাওহিদের এ অমূল্যবাণী শুনতে পেয়ে হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামও মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন-
اَللهُ اَكْبَر وَ لِلهِ الْحَمْد (আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) আল্লাহ মহান, সব প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।’
তাকবিরে তাশরিকের তাৎপর্য ও গুরুত্ব
হজ পালনকারী, কোরবানি দাতাসহ মুসলিম উম্মাহর জন্য জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত উল্লেখিত ৫ দিন তথা ২৩ ওয়াক্ত নামাজ শেষে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। তা শুধুই তাকবির নয় বরং তাকবিরে তাশরিক-
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَاَللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর; লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু; ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর; ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।’
অর্থ : ’আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; সব প্রশংসা মহান আল্লাহ জন্য।’
এটি মহান আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শুকরিয়া আদায়ের তাসবিহ। যা একজন প্রধান ফেরেশতা, একজন দায়িত্বশীল নবি ও ভবিষ্যৎ নবির কণ্ঠ থেকে আগত তাসবিহ-এর সমষ্টি।
এ প্রশংসা বাক্য আল্লাহ তাআলার এতই পছন্দনীয় হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তা মুসলিম উম্মাহর জন্য কেয়ামত পর্যন্ত উল্লেখিত ৫দিন (৯জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত) ফরজ নামাজের পর তা পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক করেছেন।
উল্লেখ্য, তাকবিরে তাশরিক হলো মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসার ঘোষণা। আর কোরবানি হলো আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের আরও বেশি প্রিয় হওয়ার মাধ্যম। কোরবানি ও তাকবিরে তাশরিক এক সুতোয় গাঁথা। কোরবানির সঙ্গে তাকবিরে তাশরিকের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আরবি জিলহজ মাসে হজ সম্পাদন করতে হয় আবার এ মাসে হজের নির্ধারিত দিনগুলোর প্রথম দিন ফজর নামাজ থেকে শুরু করে হজের শেষ দিন সূর্যাস্তের আগ অর্থাৎ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত নামাজে আদায় করতে হয়। আর এ সময়ের মধ্যে ১০-১২ জিলহজের মধ্যে আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে হয়।
৫ দিন তাকবির পড়তে হয় আর এর মধ্যে ৩ দিন কোরবানি করা যায়। হজ, তাকবির ও কোরবানির মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক নিবিড় সম্পর্ক। হজ ও কোরবানি যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত তেমনি তাকবিরে তাশরিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবি রাখে।
হজ কোরবানি ও তাকবিরে তাশরিকে সুসম্পর্ক
হজের মাস ও দিনক্ষণে তাকবিরে তাশরিক ও কোরবানি আদায় করতে হয়। যে দিন থেকে হজ শুরু হয় সেদিন থেকেই তাকবিরে তাশরিক শুরু করতে হয়। আবার সর্বশেষ যেদিন যে সময় মিনা ত্যাগ করতে হয়, সে সময়ই তাকবিরে তাশরিক পড়া শেষ করতে হয়। আর এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা ও ইতিহাস।
যেমনিভাবে কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেন-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ
‘এরপর সে (ইসমাইল) যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহিম তাকে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি? সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যধারণকারীর দলভূক্ত পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে তার সন্তান কোরবানির নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের কথা সন্তানকে জানালে সে-ও তা মেনে নেন। অতঃপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সন্তান ইসমাইলকে জবেহ করার প্রস্তুতি নিলে আল্লাহ তাআলা তার কোরবানিকে কবুল করে নিলেন।
সুতরাং মুসলিম উম্মাহর সব প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ, মুকিম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং জামাতে কিংবা একাকি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সবার ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাকবিরে তাশরিকের ইতিহাস জানার পর উল্লেখিত দিনগুলোতে শুকরিয়া হিসেবে এ ওয়াজিব কাজ ‘তাকবির’ আদায় করে তার একান্ত নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম