রাজশাহীতে আমের বাজার সরগরম। শুধু কি স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে? মোটেই না! বরং রাজশাহী ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর উদ্যোমী তরুণ-তরুণীরা আমের ব্যবসার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। তারা সারা দেশের ক্রেতাদের জন্য অনলাইনে আম বিক্রি করছেন। এতে খুব সহজে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু আমগুলো ন্যায্যমূল্যে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্বত্র! ক্রেতারা পাচ্ছেন সুলভমূল্যে ফরমালিনমুক্ত, গাছপাকা আম। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষক, ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই।
Advertisement
আম নিয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জের আরেক উদ্যমী তরুণ ইশতিয়াক আসিফের সঙ্গে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালিতে অবস্থান করছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি আবার সহধর্মিণীকে পাশে নিয়ে, সুনামের সঙ্গে আমের ব্যবসাতেও যুক্ত আছেন দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ।
ইশতিয়াক আসিফ জানান আম ব্যবসা করার কারণ। গোছানো উত্তরে তিনি জানালেন তার স্বাবলম্বী হওয়ার ঘটনাগুলো। সবসময় নতুন কোনো কিছু নিয়ে আগানোর কথা চিন্তা করলে মাঝপথে হোঁচট খাওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ইশতিয়াকের বেলাতেও অন্যথা হয়নি। তাই তো সে সাফল্যের রঙিন গল্পের পাশাপাশি তিনি জানালেন গোটা পথ চলার, থমকে দাঁড়ানোর ও আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলার ঘটনাও।
ইশতিয়াক বলেন, ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই। তখন রাজশাহীর বিখ্যাত একটি কোচিং সেন্টার সান ডায়ালে খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করি। কোচিং সেন্টার থেকে যে অর্থ উপার্জন করতাম তা দিয়ে নিজের হাত খরচও হতো না। সব সময় ভাবতাম অন্য কী করা যায়। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে একটি ইচ্ছে ছিল যে বড় হয়ে একদিন ব্যবসা করব। ততদিনে আমের সময় চলে এলো।
Advertisement
‘রাজশাহীর আম জগৎ বিখ্যাত। এছাড়া আমের সময় অনেকেই আমাকে ফোন দিয়ে আম পাঠাতে বলে। আমিও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়মিত আম পাঠাতাম আমের সময়ে। তখন চিন্তা হলো এটাকে ব্যবসা হিসেবে চিন্তা কেন করছি না। কারণ ততদিনে অনেক আড়তদার এবং আম বাগানের মালিকদের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। আর তখন থেকেই তার আম কেন্দ্রিক ব্যবসার গোড়াপত্তন।’
তিনি জানান, প্রথমে আড়তদারদের থেকে আম নিয়ে পাঠালেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র বাগান মালিকদের থেকে আম নিয়েই পাঠাতাম। কারণ আড়তদারদের কাছে বিভিন্ন বাগানের বিভিন্ন রকমের আম যখন একসাথে আসে এবং পরবর্তীতে একসাথে যখন মিশে যায়, তখন আমের কোয়ালিটির গ্যারান্টি থাকে না। তখন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এ রকম ব্যবসা ছিল না।
আমার পুরো ব্যবসাটাই হতো ওভার দ্য ফোন এবং বিশ্বাস এই দুইটা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। ক্রেতারা ছিল আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং আত্মীয়-স্বজনদের পরিচিত জনেরা। খুবই স্বল্প লাভে আমি আম সরবরাহ করতাম। এভাবে আস্তে আস্তে আমার ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
আমের গুণগত মানের ব্যাপারে ইশতিয়াক বলেন, ফরমালিনমুক্ত এবং স্বাদে সেরা আম সরবরাহ করা ছিল আমার মূল লক্ষ্য। গ্রাহকরা ভালো মানের আম পেয়ে তাই পুনরায় অর্ডার দিতে থাকলেন। এভাবে আমের সিজনে আমের ব্যবসা করে দেখা যেত আমার সারা বছরের হাত খরচ উঠে যেত। প্রত্যেক বছর গ্রাহক সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।
Advertisement
ব্যবসা নিয়ে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিলো জানতে চাইলে বলেন, পথটা ছিলো কন্টকাকীর্ণ। প্রতিটি ব্যবসারই কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। আম নিয়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলো এভাবেই। অনার্স শেষ করে যখন মাস্টার্সে ভর্তি হলাম তখন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমিও মনে মনে ভাবছিলাম কিছু একটা করব।
‘এই সময় আমার আরও তিন বন্ধু মিলে শেয়ারে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি যেখানে আমাদের পণ্য ছিল শাড়ি, ওড়না, থ্রি পিস, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন রকমের ক্রাফটের সামগ্রী যা আমরাই তৈরি করতাম। আর শাড়ি ওড়না থ্রি পিস এগুলো আমরা দেশের বিভিন্ন পাইকারি মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতাম। মোটামুটি গ্রোথ ভালই ছিল এই বিজনেসের। কোনো এক সময় আমার বন্ধুরা আলাদা হয়ে যাই। তখন ২০১৯ সালের শেষ দিকে আমি আর আমার বন্ধু একসাথে আমাদের নতুন উদ্যোগ, ‘সহজিয়া’-এর সাথে যাত্রা শুরু করি।’
নিজের অনলাইন বিজনেস পেজের নাম ‘সহজিয়া’ রাখার কারণ জানতে চাইলে ইশতিয়াকের সোজাসাপ্টা জবাব, সহজিয়া নামটা বেছে নেওয়ার কারণ আমরা সহজভাবে ক্রেতাদের কাছে সঠিক ও সেরা পণ্য পৌঁছে দিতে চাই। প্রথম থেকেই আমরা যে পণ্য তৈরি করতাম তা বিক্রয় করে ভালো সাড়া পাই। বাটিকের থ্রি পিস, শাড়ি, ওড়না, মেয়েদের কাঠের অলংকার, পাঞ্জাবি (কাস্টমারদের পছন্দমত ডিজাইনও করে নিতে পারতেন) এবং আরও নানা কিছু আমরা বিক্রি শুরু করলাম।
অনেকগুলো উদ্যোক্তা মেলাতে অংশগ্রহণ করে ভালো সাড়া পেয়েছি। তখন আমি অস্ট্রেলিয়া গভর্মেন্টের একটি প্রজেক্টের সহযোগী গবেষক হিসেবে কাজ করি। আমার বন্ধু মূলত প্রোডাকশনের কাজগুলো করত এবং আমি যেহেতু খুব একটা সময় দিতে পারতাম না সেহেতু মার্কেটিংয়ের বিষয়টা দেখতাম। আমরা মূলত দেশীয় পণ্য বিক্রি করতাম এবং আমের সিজনে আম।
ব্যবসা সম্পর্কে তিনি আর জানান, সহজিয়া সবসময় ভোক্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দেখা যেত অনেক সময় দুই একজনের কাছে কিছু আম হয়তো খারাপ গেছে। কারণ অনেক সময় ঝড় বৃষ্টির কারণে আম বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হলেও ভেতরে আঘাত থেকে যাওয়ার কারণে আমের গুণাগুণ ঠিক থাকে না। আমরা এ রকম ঘটনা ঘটলে সব সময় পুনরায় নিজেদের পক্ষ থেকে সেই ভোক্তাকে আম পাঠিয়ে থাকি। এজন্য যারা সহজিয়ার সাথে একবার জুড়ে যান তারা আর অন্য কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।
সহজিয়া নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে আসিফ বলেন, আমার ইচ্ছে রয়েছে ‘সহজিয়া’-এর মাধ্যমে আমাদের গ্রাম বাংলার দেশীয় সব পণ্য যেন সহজে সবার কাছে পৌঁছাতে পারে। সেই লক্ষ্য নিয়েই আপাতত কাজ করছি। সহজিয়ার শুরুতে যে পার্টনার বন্ধুর কথা বলেছিলাম তিনি এখন আমার সহধর্মিণী কানিজ ফাতেমা নিশিতা। তার ভালোবাসার জায়গা হচ্ছে এই ‘সহজিয়া’। যেহেতু আমি এখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছি, এই কারণে আপাতত আমাদের পেজের কার্যক্রম কিছু সীমিত রয়েছে। আশা করছি পুরো উদ্যমে আবার শিগগিরই শুরু করব।
এমআরএম/এমএস