বিভিন্ন চ্যানেলে আমরা প্রায়ই বিস্ময়কর প্রাণী তিমির ভিডিও দেখে থাকি। দর্শকদের অবাক করা কৌতূহল মেটাতে চ্যানেলগুলোর চমৎকার ভিডিও আয়োজন। বিশাল সাগরে রাজত্ব করে বেড়ায় তিমি। বিশাল এই প্রাণীর জীবনাচরণ আজও মানুষকে অবাক করে। তিমির বৈচিত্র্যময় জীবন মানুষকে বিস্মিত ও ভাবিত করবে যুগ যুগ ধরে।
Advertisement
তিমিকে আমরা অনেকেই মাছ বলে জানি। এমনটা ভাবার সঙ্গত কারণও আছে। তিমি মাছের মতো জলচর প্রাণী এবং মাছের মতো এদেরও লেজ আছে। তবে এরা মাছের মতো ফুলকা দিয়ে নিঃশ্বাস নেয় না। আবার মাছের মতো ডিমও পাড়ে না। মানুষের মতো ফুসফুস দিয়ে অক্সিজেন নেয়। আবার পানিতেই খাওয়ায় শিশু তিমিকে বুকের দুধ। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তিমিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মনে করতেন। দীর্ঘ শত শত বছর পর অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক জীববিজ্ঞানীরা একমত হন, তিমি আসলে মাছ নয়; বরং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণী।
মানুষও স্তন্যপায়ী প্রাণী। তিমিও মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী। সাগরের পানির ওপর ভেসে থাকা দানব আকৃতির তিমিরও আছে ঘর-সংসার। আহার, বিহার, বিনোদন—সবই ওদের নিত্যসঙ্গী। এই তিমি সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীও বটে। শুধু এদের জিভের ওজন পূর্ণবয়স্ক একটি হাতির ওজনের সমান। এরা লম্বায় প্রায় তেত্রিশ মিটার হয়ে থাকে। যা একটি প্রমাণ সাইজ টেবিল টেনিস কোর্টের সমান। দেহের ওজন হয়ে থাকে একশ থেকে একশ বিশ টনের মতো। এদের দেহে ঝড়ো বাতাস বা হাওয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা আছে। এরা প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার টন খাবার খেয়ে থাকে। তিমির জীবন বৈচিত্র্য সত্যিই অবাক করার মতো। আকার আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কারণে তিমিদের বিভিন্ন প্রজাতি আমাদের চোখে পড়ে।
আরও পড়ুন: জলে ভাসে ডাঙায় চলে
Advertisement
সাই তিমি সাই তিমি লম্বায় সাধারণত চৌদ্দ-পনেরো মিটার হয়ে থাকে। তবে এরা একুশ মিটার পর্যন্ত লম্বাও দেখা গেছে। আর ওজন ত্রিশ টনের মতো হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব সাগরে, বিশেষত নাতিশীতোষ্ণ এবং গভীর সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে এরা বসবাস করে। এদের গায়ের রং গাঢ় কালো বা নীলচে ধূসর। দেহ একহাড়া সাবলীল। গায়ের রঙে মাঝে মাঝে সাদাটে দাগ দেখা যায়। এই রং আবার নিচের দিকে ফিকে হয়ে থাকে। শীতকালে সাই তিমি শীত সইতে পারে না বলে গরম জায়গার দিকে চলে যায়। তবে ওরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের সাগর থেকে যেতে একটু দেরীই করে বৈকি! তার আগে নীল বা ফিন তিমি চলে যায় অন্য সাগরে। এসব তিমি পোলার বা মেরুসাগরে যায় আরও বেশি খাবারের সন্ধানে।
এরা সাধারণত প্লাংকটন, ছোট ছোট মাছ বা স্কুইড জাতীয় শ্যাওলা প্রচুর খেয়ে থাকে। সাই তিমি মুখ হাঁ করে সাগরে সাঁতার কাটে। এরা সাগরের উপরিতলে খাবার সংগ্রহ করে। শিকার ধরার জন্য এরা প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়ে বা ডাইভিং করে। এমনিতেই ওরা সাঁতার কাটে সমান্তরাল ভাবে। কখনো আড়াআড়িভাবে সাঁতার কাটে না। অবশ্য বলিন তিমিরা তা করে থাকে। একহাড়া গড়নের দেহের কারণে প্রাণিজগতে সাই তিমি আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। সাঁতারেও দক্ষ হিসেবে ওদের নামডাক আছে। ওরা খুবই খুবই দ্রুতগামী। সাঁতার কাটার গতি প্রতিঘণ্টায় সাইত্রিশ কিলোমিটার। অন্য তিমির মতো সাই তিমির কোনো কোনো সময় ঘুমের প্রায়োজন হয়। ঘুমের সময় এক চোখ বন্ধ রাখে এবং অন্যটি খোলা রাখে। এরা সাগরের উপরিতলে ঘুমোয়। মাঝে মাঝে ঘুমোতে ঘুমোতে ভেসে উপরে ওঠে। আবার নিচে নামে। কখনো বা ছোট বৃত্তের মধ্যে সাঁতার কেটে চলে।
পাখনা তিমি সাগরে আরেক ধরনের তিমি আছে। যাদের বলা হয় পাখনা তিমি। এদের কেউ কেউ ফিন ব্যাক বা রেজর ব্যাক নামেও ডাকে। কারণ এদের পাখনার পেছন থেকে দেহের পেছনের দিকে একটি খাড়া চূড়া বা রিজ থাকে। সাধারণত এদের দেহ সাতাশ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। আর ওজন হয়ে থাকে আশি টনের মতো। পৃথিবীর সব সাগরে এদের দেখতে পাওয়া যায়। গায়ের রং গাঢ় বাদামি, ধূসর, অথবা কালো হয়ে থাকে। তবে দেহের নিচের দিকটা কিছুটা হালকা রঙের। কখনো কখনো হাল্কা স্ট্রাইপ থাকে এতে। তবে স্ট্রাইপগুলো মাথার পেছনের দিকে থাকে। কেবল নীল তিমিরা এর চেয়ে বড় এবং ওজনে ভারী হয়ে থাকে। এই তিমি সাঁতার কাটার সময় মুখ হাঁ করে যে খাবার এরা মুখে ঢোকায়, তা ফিল্টার করে নেয়। এদের মুখে অনেকগুলো প্লেট থাকে। এগুলো ফিল্টারের কাজ করে। এরা সাগরের পানিকে ওই প্লেটের মধ্য দিয়ে পাঠায়, যাতে সাগরের পানির মধ্যে যে খাবার আছে তা সংগ্রহ করে।
আরও পড়ুন: সাদা ইঁদুর যখন পোষাপ্রাণী
Advertisement
নীল তিমিসাগরের আরেকটি তিমির নাম নীল তিমি। এদের দেহ নীল বলেই এমন নাম। তবে দেহের নিচের দিকের রং কিছুটা হাল্কা। প্রথম যখন জাহাজ আবিষ্কার হয়, তখনো মানুষ জানতো না কীভাবে নীল তিমি শিকার করতে হয়। কারণ নীল তিমি এত জোরে সাঁতার কাটতো যে, ওরকম জাহাজ দিয়ে নীল তিমি শিকার করা যেত না। শিকার করতে না পারার কারণে অন্য অনেক তিমির চেয়ে নীল তিমি ভালো অবস্থায় টিকে ছিল। কিন্তু যখন মানুষ বাষ্পীয় জাহাজ বা স্টিম জাহাজ আবিষ্কার করলো তখন থেকেই নীল তিমিদের অবস্থা হলো করুণ। ১৯৩০ সালেই ৩০ হাজার নীল তিমি শিকার করা হয়। এরপর অবশ্য তিমি কমিশন গঠন করে তিমি রক্ষা করা হয়। বর্তমানে মাত্র কয়েক হাজার নীল তিমি গোটা পৃথিবীর সাগরে বেঁচে-বর্তে আছে।
কুঁজো তিমির গানএই বিশ্ব প্রকৃতিতে সবচেয়ে জটিল ও লম্বা প্রেমের গান গায় কুঁজো তিমি। তিমির গানে ছন্দ আছে, সুর আছে, আছে লয়। তিমির একেকটি গান ছয় থেকে তেত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়ে থাকে। তিমি একটা গান শেষ করে তো আরেকটা গান শুরু করে। কয়েকশ মাইল দূর থেকেও তিমির এই গান শোনা যায়। তবে সাগরভেদে এই গানের ভিন্নতাও আছে। গবেষকদের মতে, তিমিরা নিজেরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক ধরনের সুরেলা শব্দ করে। যা তিমির গান নামে পরিচিত। তিমির বিশালতা ও শক্তিমত্তার মতোই এদের গানও অনেক জোরালো হয়। সব দাঁতযুক্ত শিকারী তিমি (অডোন্টোসেটি) শব্দযোগাযোগ ব্যবহার করে, যা বহু মাইল দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়। জানা গেছে, তিমি ১৬৩ ডেসিবেল শব্দ তীব্রতায় ২০ হাজার অ্যাকোস্টিক ওয়াটে শব্দ তৈরি করে। এদের গায়ের আকার প্রায় আঠারো মিটার আর ওজন হয় প্রায় ত্রিশ টন। গোটা সাগর পানিতে এরা বিচরণ করতে পারে। বিশেষ করে মহাদেশগুলোর কিনারায় এদের অবস্থান। এদের গায়ের রং প্রধানত কালো। তবে অনেক সময় ছোপ ছোপ সাদা সাদা দাগ দেখা যায়। বড় বড় নখযুক্ত মাথাাটি অপেক্ষাকৃত লম্বা হয়।
শিকারী তিমিকিলার হোয়েল বা শিকারী তিমি অত্যান্ত হিংস্র প্রকৃতির। ওরা সীল, শুশুক, পেঙ্গুইন এবং নানা প্রকার সামুদ্রিক পাখি শিকার করে খায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সমুদ্রের বিভীষিকা। হাঙরের সঙ্গে এদের তুলনা করা যায়। এদের সামনে পড়লে কারও নিস্তার নেই। সাগরের পানির ওপরে এদের ত্রিভুজাকার পাখনা দেখলেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রাণভয়ে ছোটোছুটি করতে শুরু করে। একবার বেরিং প্রণালিতে এমন এক শিকারী তিমি ধরা পড়ে। তার পেটের মধ্যে বত্রিশটি পূর্ণবয়স্ক সীল পাওয়া যায়। কারণ এই তিমি অনেক সময় দলবেঁধে অন্য তিমিকে আক্রমণ করে এবং তার মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। এরকম চলতে থাকে যতক্ষণ না সেই হতভাগ্য তিমিটি প্রাণ হারায়। তখন অন্য তিমিরা দলবদ্ধভাবে মনের সুখে ভোজ লাগায় এবং তার মাংস গিলে খায়।
আরও পড়ুন: ডাইনোসর যুগের প্রাণী তুয়াতারা
মানুষের মতোই স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে তিমিদের সংসার জীবন। তিমির প্রধান খাবার প্লাঙ্কটন। এছাড়া কুচো চিংড়ির মতো ছেটো ক্রান্সটাসিয়ান নামক এক ধরনের জলজ পোকা জাতীয় প্রাণী তিমির মজাদার খাবার। যেখানেই এমন খাবার বেশি দেখা যায়, সেখানেই তিমিরা আস্তানা গাড়ে। এদের মুখের মধ্যে দাঁত নেই। তবে এদের মুখের মধ্যে এক রকম পাতলা ঝালর থাকে। যা ছাঁকনির মতো কাজ করে। এর সাহায্যে তিমি পানি থেকে খাবার ছেঁকে নিয়ে খেতে পারে। গরমের দিনে মেরু অঞ্চলে যখন বরফ গলে, তখন খাবারের খোঁজে এরা সেখানে গিয়ে হাজির হয়। আর সেখানেই এদের বাচ্চা হয়। বাচ্চা মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। শীত পড়লে, উষ্ণ তট অঞ্চলে এরা চলে আসে। সীল উষ্ণ রক্তের প্রাণী হলেও তিমিকে সব সময় বরফ গলা ঠান্ডা পানিতে বাস করতে হয়। তাই শীতের কামড় থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিমির চামড়ার নিচে পুরু চর্বির আস্তরণ থাকে।
তিমি যেহেতু গভীর জলের প্রাণী, তাই আদিকালে তিমি শিকার করাটা সহজসাধ্য ছিল না। বর্তমানে আধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তিমিকে খুঁজে বের করে শিকার করা হয়। তিমির মাংস আমাদের খাদ্যতালিকায় না থাকলেও পৃথিবীর বহু দেশে এর মাংস, চর্বি খাদ্য হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। এছাড়া এদের চামড়া ও পরিপাকতন্ত্রের একধরনের সুগন্ধি বস্তুর যথেষ্ট বাণিজ্যিক মূল্য আছে। তিমির হাড় এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি, যা প্রাণীদের শিং বা মানুষের হাতের আঙুলের নখের মতো অনেকটা। পাখনা তিমির হাড়ের রং হলুদ বা ধূসর সাদা হয়ে থাকে। এই হাড় দিয়ে দামি ছাতার বাট, ছুরির হাতল, চশমার ফ্রেম ও জুয়েলারি সামগ্রী তৈরি করা হয়। মানুষের লোভের কারণে দিন দিন তিমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাগরের জেলেদের জালে আটকা পড়ে আহত, অভুক্ত তিমি মারা যাচ্ছে। যে কারণে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তিমিকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জিকেএস