ক্যাম্পাস

শেকৃবি ক্যাম্পাস যেন মাদকের ‘হটস্পট’

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি)। এখান থেকে মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। বলা হয়, ঢাকায় মাদক কারবারের অন্যতম কেন্দ্র এই বিহারী ক্যাম্প। অপরদিকে ক্যাম্পাসের প্রথম ফটকেই গাবতলী টু আসাদ গেটের রাস্তা। আর দ্বিতীয় ফটক পার হলেই ফার্মগেট টু মিরপুরের প্রধান সড়ক। এরমধ্যে আবার শের-ই-বাংলা নগরের মধ্যে অন্যতম খোলামেলা এবং নিরিবিলি পরিবেশ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। এছাড়া ৮৭ একরের শেকৃবি ক্যাম্পাসে আছে বস্তি। যেখানে মাদক এবং বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ হয়ে থাকে। ফলে সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাতের আধারে নিয়মিত বসছে বহিরাগত এবং শিক্ষার্থীদের মাদকের আসর। এখানে প্রতিনিয়তই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের গন্ধ।

Advertisement

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রাতে ক্যাম্পাসের আশপাশ থেকে আসা বহিরাগত এবং ভেতরের শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের মাদক সেবন ও কেনাবেচার প্রধান হটস্পট হয়ে উঠেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া আলোর স্বল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসামাজিক ও অশালীন কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাস্তার লাইট নষ্ট, ক্যাম্পাসের ভেতরে বস্তিবাসীর সঙ্গে মাদকের সম্পৃক্ততা এবং নিরাপত্তাকর্মীদের অবহেলায় ক্যাম্পাসে দিন দিন বেড়ে উঠছে মাদক কারবারি।

আরও পড়ুন: শেকৃবির গবেষণার মাঠ যেন মাদকের ‘আড্ডাখানা’

সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রবেশ গেট থেকে কৃষি অনুষদ পর্যন্ত রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো বেশিরভাগই নষ্ট। এছাড়া প্রথম গেটে প্রবেশের পর শেখ কামাল ভবন থেকে সয়েলের মোড় পর্যন্ত সাতটি ল্যাম্পপোস্টের পাঁচটিই অকেজো। ফজিলাতুন্নেছা হল থেকে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত ছয়টি লাইটের অর্ধেকই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এছাড়া ক্যাফেটেরিয়া থেকে কৃষি অনুষদে যাওয়ার রাস্তায় একটিও লাইট নেই। নতুন লাইট লাগানোর অল্পদিনের মাথায় বারবার অকেজো হয়ে যায়। ফলে ওই রাস্তায় অন্ধকারে প্রায়ই অনৈতিক কাজের ঘটনা ঘটে। এতে করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেট থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তায় তিনটি ল্যাম্পপোস্টের সবকয়টি লাইট অকেজো। টিএসসির দক্ষিণ পাশেও নেই কোনো ভালো আলোর ব্যবস্থা। এতে করে মৃদু আলোতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। দিনের বেলা পাওয়া যায় মাদকসেবনের বিভিন্ন সরঞ্জাম।

Advertisement

আরও পড়ুন: মাদক মামলার হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে মাদক বিক্রি!

এছাড়া প্রশাসনিক ভবন থেকে শহীদ মিনার যাওয়ার রাস্তায় নয়টির মধ্যে দুটি, এবং সেন্ট্রাল মসজিদ যাওয়ার রাস্তায় চারটির মধ্যে একটি, সেন্ট্রাল মসজিদ থেকে শেরেবাংলা হল এবং মাঠের পাশে ছয়টির মধ্যে দুটি লাইট অকেজো হয়ে রয়েছে। নবাব চত্বর ও টিএসসির পাশেও কোনো লাইটের ব্যবস্থা নেই।

একাধিক মাদকসেবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্ধকার ও নিরিবিলি পরিবেশই মাদক সেবনের স্থান নির্ধারণে প্রধান কারণ। এছাড়া নিরাপত্তাকর্মীদের অবহেলায় ছাত্র সেজে সহজেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন মাদকসেবীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পাপন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ক্যাম্পাসকে মাদক সেবনের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ পাশেই ক্যাম্প মার্কেট ও তালতলা থেকে মাদকের সহজলভ্যতা এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে অন্ধকার পরিবেশ। আবার ক্যাম্পাসেই কিছু মৌসুমি কারবারি রয়েছেন, যারা বাড়ি থেকে মাদক কিনে এনে কম দামে বিক্রি করেন। সিন্ডিকেট চেইনের মাধ্যমে তারা এগুলোর খোঁজ পান। এছাড়া ক্যাম্পাসের ছাত্রদের সঙ্গে বহিরাগতদের বন্ধুত্বতাও মাদকের কারণ।

Advertisement

আরও পড়ুন: পুলিশ-সাংবাদিক-বিত্তবানরাও মাদক সাপ্লাই করেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদ্য মাদক ছেড়ে দেওয়া এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, অন্ধকার পরিবেশ হওয়ায় বহিরাগত এবং ক্যাম্পাসের ছাত্রদের মাদক সেবনের আড্ডা নিয়মিতই বসে এখানে। প্রতিদিন বাইরে থেকে গাড়ি বা বাইক নিয়ে অপরিচিত ২০-৩০ জন মাদক সেবন করতে আসেন। আবার বন্ধুদের মধ্যে ৪-৫ জন আসে সবসময়। মাদক সেবনের মধ্যে অনেকে এমন আছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ভর্তি বাতিল করে প্রাইভেট পড়ছেন। তবে বেশিরভাগ মাদক আসে বিহারী ক্যাম্প থেকে। মাত্র ৩৫০ টাকায় ১২ গ্রাম গাঁজা রাস্তায় পাওয়া যায়। এসব গাঁজা কিনে ক্যাম্পাসে চলে আসেন তারা।

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, মিরপুর থেকে আসা মাদকসেবীরা মূলত ইয়াবা সেবন করেন। আর ফার্মগেটের শাহ আলম আর রেড বাটন বার থেকে কেরুর ভোটকা এবং কেরুর হুইস্কি এবং বান্দরবনের চো নামে সহজলভ্য মদ নিয়ে আসেন।

মাদক নিয়ন্ত্রণে এই শিক্ষার্থী বলেন, মাদক সেবনের প্রধান জায়গা টিএসসি এবং অক্সফোর্ড রোড। এই দুই জায়গা লাইট ও সিসি ক্যামেরার আওতাধীন করলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর সন্ধ্যার পর বিহারি ক্যাম্প তথা প্রধান ফটকের রাস্তায় বহিরাগতদের চেক করিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

আরও পড়ুন: এবার দেশে মিললো আরেক ভয়ংকর মাদক ‘ডিওবি’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. অধ্যাপক হারুন-উর-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রায় অর্ধশতাধিক বহিরাগত মাদকসেবী ধরেছি। ক্যাম্পাসের লাইট নিয়ে সমস্যা এটা দেখার দায়িত্ব ইঞ্জিনিয়ার সেকশনের। আমরা নিয়মিত রিপোর্ট দেই তাদের। ঈদের পর টিএসসি এবং অক্সফোর্ড রোডে হ্যালোজেন লাইট লাগিয়ে দিতে বলবো।

নিরাপত্তা শাখার ইউনুস আলী বলেন, গত সপ্তাহে ইঞ্জিনিয়ার সেকশনকে লাইট নষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছি। সম্ভবত আজকালের মধ্যে ঠিক করে দেবে তারা।

প্রধান প্রকৌশলী মোমেনুল আহসান বলেন, লাইট অকেজোর বিষয়টি অবগত। আজকে লোক পাঠিয়ে দেখবো।

তবে মাদক নিয়ে শের-ই-বাংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, আমি আসার আগে শেরেবাংলা ক্যাম্পাসে মাদকের আখড়া ছিল। এখন আমরা নিয়মিত টহল দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও মাদক নিয়ে সবসময় এলার্ট থাকেন। ফলে এখন মাদকের পরিমাণ বেশ কম।

তাসনিম আহমেদ তানিম/জেডএইচ/জিকেএস