টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া সাবমেরিনের ভাগ্যেও একই পরিণতি হলো। গভীর সমুদ্রে বিস্ফোরণে এর সব আরোহী মারা গেছেন। মার্কিন কোস্টগার্ড আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সাবমেরিন টাইটান পরিচালনাকারী সংস্থা ওশেনগেটের পক্ষ থেকেও একই তথ্য জানানো হয়েছে।
Advertisement
নিখোঁজ সাবমেরিন টাইটানের পাঁচটি বড় টুকরা শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত টুকরাগুলোর মধ্যে রয়েছে- একটি ‘নোজ কোন’, প্রেসার হুলের বাইরের অংশবিশেষ ও বড় একটি ধ্বংসাবশেষ ক্ষেত্র। যেখানে টাইটানিক জাহাজ ধ্বংস হয়েছিল, তার ঠিক আশপাশে এগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার তথ্য নিশ্চিত হয়েছে মার্কিন কোস্টগার্ড।
আরও পড়ুন: সাবমেরিন টাইটানের কেউই বেঁচে নেই
টাইটানের এই পরিণতির পর নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে। ঠিক কী কারণে এটি নিখোঁজ হলো এবং পরবর্তীতে এতে কীভাবে বিস্ফোরণ হলো বা সেখানে প্রকৃত পক্ষে কী ঘটেছিল তা আর জানা সম্ভব হবে না। তবে ওশেনগেটের এক সাবেক কর্মকর্তা ২০১৮ সালেই এর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের কিছু নথিতে দেখা যায়, কোম্পানির সাবেক মেরিন অপারেশনের পরিচালক ডেভিড লকরিজ তার এক প্রতিবেদনে এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেকগুলো জায়গা শনাক্ত করা হয়েছিল যা নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি। একই সঙ্গে এটা যেভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
এই ডুবোযান যখন পানির একেবারে গভীরে যাবে তখন সেখানে থাকা যাত্রীদের জন্য সেটি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন ডেভিড লকরিজ। তিনি জানিয়েছিলেন, তার এই সতর্কতা উপেক্ষা করা হয় এবং তিনি যখন ওশেনগেটের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক ডাকেন তখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
কোম্পানি তার বিরুদ্ধে গোপনীয় তথ্য প্রকাশের অভিযোগে মামলা করে। পরবর্তীতে অনৈতিকভাবে ছাঁটাই করার কারণে তিনিও পাল্টা মামলা করেন। পরে দুপক্ষই মামলার বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় আসে তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
তবে টাইটানের দুর্ঘটনার পর লকরিজ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া ওশেনগেটকে ২০১৮ সালের মার্চে আলাদাভাবে একটি চিঠি দেয় মেরিন টেকনোলজি সোসাইটি-এমটিএস। যা নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে আসে এবং এতে লেখা হয় যেভাবে ওশেনগেটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে...তার ফলাফল নেতিবাচক হতে পারে (সামান্য থেকে ভয়াবহ বিপর্যয় পর্যন্ত)।
Advertisement
টাইটানের প্রধান কাঠামো যেখানে যাত্রীরা বসে তার চারপাশ কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। এর সাথে ব্যবহার হয় টাইটানিয়ামের প্লেট এবং একপাশে একটা ছোট জানালা রাখা হয়।
পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বায়োলজি বিষয়ের লেকচারার ড. নিকোলাই রটেরডাম বলেন, সাধারণত গভীর সমুদ্রের ডুবোযান যা মানুষ বহন করে সেটি প্রায় দুই মিটার ব্যাসরেখার টাইটানিয়াম স্ফেয়ারের হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: সাবমেরিন টাইটানের ৫ টুকরো শনাক্ত: মার্কিন কোস্টগার্ড
তিনি বলেন, পানির গভীরে যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয় তা মোকাবিলায় আপনার খুবই শক্তিশালী উপাদান লাগবে যাতে পানির ওজন আপনাকে প্রতিনিয়ত নিচের দিকে নিতে থাকলেও আপনি সেটা এড়িয়ে যেতে পারেন।
কার্বন ফাইবার টাইটানিয়াম বা স্টিলের চেয়ে কম দামি কিন্তু এটাও খুবই শক্তিশালী। কিন্তু টাইটানের মতো গভীর সমুদ্রের ডুবোযানের ক্ষেত্রে তা এখনো পরীক্ষিত নয়।
গত বছর ওশেনোগ্রাফিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওশেনগেটের প্রধান নির্বাহী রাশ টকটন বলেন, কার্বন ফাইবার ইয়ট এবং এভিয়েশনে সাফল্যের সঙ্গেই ব্যবহার হচ্ছে তবে মানুষ থাকবে এমন ডুবোযানে এখনো ব্যবহার করা হয়নি।
এর আগে আদালতের নথিতে লকরিজ দাবি করেছিলেন, এর কাঠামো কতেটা চাপ নিতে পারে এবং এর সম্ভাব্য সমস্যাগুলো কী তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। তার দাবি এটি কতটা চাপ নিতে পারে সেটার একটা ছোট স্কেলে পরীক্ষার সময় এই ডুবোযানের কার্বন ফাইবারে বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে।
একই সঙ্গে টাইটানে যে ছোট জানালা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন লকরিজ। তিনি বলেন, যারা এটি বানিয়েছে তাদের সেই উপকরণ তখনই স্বীকৃতি পাবে যখন তা ১৩০০ মিটার গভীরে ব্যবহার করা হবে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওশেনগেট এক বিবৃতিতে জানায়, টাইটান ৪০০০ মিটার গভীর পর্যন্ত গিয়েছে যা এর কার্বন ফাইবার ও টাইটানিয়াম কাঠামোর ব্যাপারে ওশানগেটের উদ্ভাবনী প্রকৌশল ও নির্মাণকে নিশ্চিত করে।
২০২০ সালে গিকওয়্যারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাশ বলেন, পরীক্ষায় ডুবোযানটি টানা ব্যবহারে কিছু ক্লান্তির ছাপ দেখিয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে আদালতের নথিতে বলা হয়, কোম্পানি জানিয়েছে যে টাইটান ৫০টিরও বেশি টেস্ট ড্রাইভ দিয়েছে, টাইটানিকের সমপরিমাণ গভীরে গিয়েছে, বাহামার গভীর সমুদ্রে গিয়েছে এবং একটা প্রেশার চেম্বারেও এটি নেমেছে।
টাইটানের কাঠামোও একটু ভিন্নরকম। গভীর সমুদ্রের ডুবোযানের আকৃতি সাধারণত গোলাকার হয়ে থাকে, যাতে সবদিকে এটি সমান চাপ নিতে পারে। কিন্তু টাইটান টিউব আকৃতির, ফলে এতে সবদিকে চাপ সমানভাবে যায় না।
অনুমোদন ছিল না কেন?আদালতের নথিতে লকরিজ বলেন, ওশেনগেট যাতে এই সাবমেরিনটি পরিদর্শন করায় এবং সার্টিফিকেট পায় সে ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন তিনি। এ ধরনের ডুবোযানের স্বীকৃতি দিতে পারে মেরিন প্রতিষ্ঠানগুলো- যেমন অ্যামেরিকান ব্যুরো অব শিপিং (এবিএস) বা ডিএনভি নরওয়েভিত্তিক একটি বৈশ্বিক অ্যাক্রিডিটেশন সংস্থা কিংবা লয়েডস অব লন্ডন।
এর মানে হলো যানটিকে স্থায়িত্ব, সামর্থ্য, নিরাপত্তা ও পারফরম্যান্স এমন নানা দিকে কিছু নির্দিষ্ট মান পূরণ করতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় এর নকশা ও নির্মাণ পর্যালোচনা করা হয়, ট্রায়াল দেখে তারপর সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আর একবার যখন ডুবোযান চলা শুরু করবে তারপর থেকে এটি নিয়মিত কিছুদিন পরপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে এটা সব মান নিশ্চিত করে চলছে কি না। তবে ডুবোযানের স্বীকৃতির ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক নয়।
২০১৯ সালে কোম্পানি তাদের এক ব্লগ পোস্টে লেখে, টাইটান কখনোই কোনো স্বীকৃতি পায়নি। এটা অনেকটা এভাবে বলা হয় যে টাইটান যেভাবে নকশা করা হয়েছে তাতে সেটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ছে না। কিন্তু এর মানে এটাও নয় যে ওশেনগেট প্রয়োজনীয় মান পূরণ করেছে।
এতে যোগ করা হয় প্রথাগত সংস্থাগুলো উদ্ভাবনের গতি কমিয়ে দেয়...যে কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাস্তব বিশ্বে পরীক্ষার আগে একটা বাইরের সংস্থাকে নিয়ে আসা দ্রুত উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে অভিশাপ। ২০২২ সালে টাইটানে যাওয়া এক সিবিএস রিপোর্টার মন্তব্য করেন, যাত্রা শুরুর আগে যাত্রীদের কিছু বিষয় জানানো হয়। তাদের কাছে ব্যাখ্যা করা হয় যে, এটি একটি পরীক্ষামূলক ডুবোযান যা কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদিত নয় এবং এটি আপনার শারীরিক আঘাত, মানসিক ট্রমা বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ ধরনের বিষয়গুলো উল্লেখ করা একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় যাত্রীদের।
আরও পড়ুন: নিখোঁজ সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষস্থলের সন্ধান মিলেছে
৪০০০ মিটার গভীরে যায় এমন ডুবোযান খুবই বিরল। এগুলো খুব বেশি দেখা যায় না এবং এর জন্য উদ্ভাবন ও নকশাটা অনন্য হতে হয় যাতে গভীর সমুদ্রে এটি টিকে থাকতে পারে। তবে এর মানে আবার এটাও নয় যে প্রথাগতভাবে এর স্বীকৃতি প্রদান হবে না।
উদাহরণস্বরুপ আরেকটি একটি ডুবোযান লিমিটিং ফ্যাক্টর। এর নির্মাতা ট্রাইটন সাবমেরিন যাত্রা শুরুর আগে নিয়মিত সমুদ্রের গভীরে ভ্রমণ করেছে। এমনকি ১১ কিলোমিটার গভীরে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের নিচ পর্যন্ত গিয়েছে।
এই যানটি প্রকৃতপক্ষেই অনন্য ধরনের এবং অত্যাধুনিক। তবে এই দলটি এর নকশা, নির্মাণ ও পরীক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিএনভির ক্লাসিং এজেন্সির সঙ্গে মিলে কাজ করেছে। আর লিমিটিং ফ্যাক্টর সমুদ্রের যে কোনো গভীর পর্যন্ত একাধিকবার নিরাপদে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি অনুমোদিত, যা টাইটানের ক্ষেত্রে হয়নি। নানা রকম প্রশ্ন তোলার পরও এত বড় একটি অভিযানে নামলো টাইটান। কর্তৃপক্ষ কেন এত বড় একটি ঝুঁকি নিলো সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
টিটিএন