মতামত

রাজনৈতিক, সামরিক ও বিচারব্যবস্থায় হতাশা পাকিস্তানে

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। আর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর অনুমোদন করা হয় জাতীয় সংসদে। আর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট তাদের সংবিধান পাস করে। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে পাকিস্তানের আগে সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ তার সংবিধান প্রণয়ন করে।

Advertisement

এত দীর্ঘ সময় পর সংবিধান প্রণয়ন করেও হতাশ দেশটির মানুষ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে সংবিধানের প্রস্তাবনার লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘জনগণ যাতে উন্নতি করতে পারে এবং বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে তাদের ন্যায্য ও সম্মানিত স্থান অর্জন করতে পারে’। একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় আইনজীবী ফয়সাল সিদ্দিকী তার দীর্ঘ হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন।

তিনি লিখেছেন, প্রথমে স্বল্পোন্নত দেশের তকমা বহন করতে হয়েছে দেশটিকে। তারপর ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে পাকিস্তান। এখন গোটা দুনিয়ার চোখেই অপমানিত একটি রাষ্ট্র ভিন্ন তারা আর কিছুই নয়। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারও এখন পাকিস্তানকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে জ্ঞান দেয়!

ফয়সালের মতে, একজন সাধারণ পাকিস্তানি নাগরিকের কাছে এর থেকে অপমানজনক আর কিছু হতে পারে না। সম্প্রতি সরকারিভাবেও আফগানিস্তান পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নানা মন্তব্য করেছে।

Advertisement

ফয়সালের মতে, আধুনিক চীনের উত্থানে একটি কেন্দ্রীয় আদর্শগত ভিত্তি হলো ১৮৩৯ থেকে ১৯৪৯ সালের মতো ‘অপমানের শতক’ পুনরাবৃত্তি না করার জন্য তাদের জাতীয় সংকল্প। তিনি মনে করেন, চীন তার নিজস্ব জাতীয় দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। কিন্তু পাকিস্তান পারেনি। আর এজন্য তিনি দায়ী করেছেন দেশের সামরিক, রাজনৈতিক, বিচারবিভাগীয়, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন, পুঁজিপতি, ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি এবং গণমাধ্যমের শীর্ষ নেতৃত্বকে। রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা ও অর্থ ভোগ করলেও নাগরিকদের আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি পাকিস্তান। ক্ষমতাবানরাই জনগণকে বিকশিত করে তোলার বদলে অশিক্ষার অন্ধকারে বন্দি করে রেখেছেন।

ফয়সালের মতে, প্রতিটি দেশে একটি অভিজাত শ্রেণি থাকে। তারা চায় তাদের হাতেই সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকুক। পাকিস্তানেও এই অভিজাত শ্রেণি রয়েছে। ডনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘আমাদের অভিজাতদের সমস্যা হলো যে তারা তাদের শাসন টিকিয়ে রাখতে স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত ক্ষমতা প্রদর্শন করলেও প্রয়োজনীয় জাতীয় সংস্কারের মাধ্যমে তাদের অভিজাত শক্তিকে টিকিয়ে রাখার এবং বৃদ্ধি করার জন্য তাদের কৌশলগত জ্ঞান বা বৃহত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই’।

পাকিস্তান একেবারে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। সেদেশের গণমাধ্যমেই লেখা হয় জাতীয় পুনরুজ্জীবন জরুরি। আর তার জন্য প্রয়োজন, দেশের সংঘাত অনুধাবন করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পুনরুজ্জীবনের জন্য পাকিস্তানকে প্রথমেই সমসাময়িক সংঘাতগুলো বুঝতে হবে। এ সংঘাতের মূল বিষয়টি হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের অনাস্থা, সামরিক সংস্থার জবরদস্তি মানসিকতা এবং বিচারকদের মাধ্যমে সাংবিধানিক ক্ষমতার দম্ভ।

Advertisement

এই তিন শক্তির লড়াইয়ের মধ্যে দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে পাকিস্তানের জনগণকে। ৯ মে পাকিস্তানের মানুষ সেই ক্ষোভের কিছুটা হলেও বহিঃপ্রকাশ দেখাতে বাধ্য হন। ডনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় দেশের জনগণের সাহসী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তা এখন এই সংকটময় মুহূর্তেও প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও প্রকাশ তিন ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

প্রথমত, জেনারেল আইয়ুব এবং ইয়াহিয়ার বিপরীতে, জেনারেল জিয়া এবং মোশাররফ সংবিধান বাতিল বা রহিত করতে সক্ষম হননি। তারা জনগণের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তিকে অবজ্ঞা করে সংবিধানকেই স্থবির করে রেখেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, ফয়সাল মনে করেন, খুন, নির্বাসন এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কিন্তু পাকিস্তানে সমান সক্রিয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিও পাকিস্তানের সংবিধানের মতোই টিমটিম করে হলেও জ্বলছে।

তৃতীয়ত, তিনি আসিম সাজ্জাদের বই ‘দ্য স্ট্রাগল ফর হেজেমনি ইন পাকিস্তান’ বইটির কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে সাজ্জাদ লিখেছেন, “পিটিআইয়ের অভিজ্ঞতা অনেক সমান্তরাল উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে যেখানে মধ্যবিত্ত-শ্রেণির আকাঙ্ক্ষার সাথে আবদ্ধ একটি তরুণ এবং ডিজিটালভাবে সংযুক্ত জনসংখ্যা কণ্ঠস্বর ভিত্তি তৈরি করে। একটি প্রতিক্রিয়াশীল জোট, যা ‘আধিপত্যবাদী অভিজাতদের’ একচেটিয়া ক্ষমতা ভাঙার দাবি করে”।

পাকিস্তানি এই আইনজীবী মনে করেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার মধ্যবিত্তরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। ২০০৭ সালে আইনজীবী আন্দোলনের অংশ হিসেবে এবং এখন ইমরান খানের সংহতির অংশ হিসেবে মধ্যবিত্তরা কিন্তু এগিয়ে আসছেন। ফয়সাল মনে করেন, জনগণের কণ্ঠস্বর আর উপেক্ষা করা যাবে না। সামরিক আদালত বা পারিবারিক ও বংশীয় রাজনীতির মাধ্যমে মানুষকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করাটা যে ভুল হচ্ছে সেটাও তুলে ধরেন তিনি।

১৬ বছর ধরে পাকিস্তানে কোনো সামরিক আইন বা সরাসরি সামরিক শাসন নেই। কাগজে কলমে পাকিস্তানে আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক শাসনের দীর্ঘতম সময়কাল চলছে। পাকিস্তানি গণমাধ্যমটির মতে, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার একচেটিয়া আধিপত্যের দিনও শেষ। সামরিক শক্তির আধিপত্য অবশ্য রয়ে গেছে।

অন্যদিকে, বেসামরিক আধিপত্য ও গভীর সাংবিধানিক গণতন্ত্রের উদার স্বপ্ন পূরণের জন্য যে টেকসই গণসংহতি ও বিপ্লবী রাজনীতির প্রয়োজন ছিল সেটাও পাকিস্তানে নেই। তাই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ওপর বহু বছর ধরে একটি শক্তিশালী সামরিক ছাপ রয়েছে।

কিন্তু সামরিক সংস্থা এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকাও তিনটি কারণে এ দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সহিংসতার ওপর সামরিক বাহিনী ছাড়া কোনো শক্তিই একচেটিয়া অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। গৃহযুদ্ধ এবং বিশৃঙ্খলা সামরিক শক্তির একটি ব্যর্থতার প্রতিফলন।

দ্বিতীয়ত, সামরিক মদত ছাড়া কোনো মৌলিক সংস্কার পাকিস্তানে সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, শুধু একটি শক্তিশালী এবং পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীই পাকিস্তানকে সীমান্তের দুই পারের দুটি হুমকির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। আফগানিস্তানের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গেও পাকিস্তানের শত্রুতার কথা বলা হয়েছে ফয়সালের এই লেখায়।

বিচারকরা চান বা না চান অথবা তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করুন বা না করুন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে তাদেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। উচ্চতর বিচার বিভাগ দুর্বল ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রক্ষা করে উভয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘জনগণের’ রাজনীতির বিরুদ্ধে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া এটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সামরিকীকরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমাগত হুমকির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ একটি সাংবিধানিক প্রাচীর হিসেবেও বিবেচিত। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব কতোটুকু পালন করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ পাকিস্তানিদের মনে।

পাকিস্তানি আইনজীবী ফয়সালের মতে, জাতির ভাগ্য নিহিত রয়েছে মানুষ, তরবারি ও কলমের ভারসাম্যে। মানুষ মানে জনগণ বা রাজনৈতিক শক্তি। তরবারি হচ্ছে সামরিক শক্তি এবং কলম বলতে তিনি দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য তার মতে, প্রয়োজন অবিলম্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মধ্যে ক্ষয়কারী অচলাবস্থা অপসারণ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রতিশোধের জন্য সামরিক নেতৃত্বের নিরাপত্তাহীনতা দূর করা।

কিন্তু আদৌ কি এই প্রয়োজন মিটবে? পাকিস্তানি আইনজীবী নিজেই আত্মবিশ্বাসী নন। ফলে সামনে আরও দুর্ভোগ যে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভোগ করতে হবে, সেটা তারা ভালোই বুঝছেন। তারই প্রতিফলন চোখে পড়ছে তাদের দেশের গণমাধ্যমে। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন খোদ পাকিস্তানের বিশ্বাস ছিল, এই রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ব্যর্থ হবে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৭৩ সালে প্রায় ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেশটিকে অবাক করে দেয়। বাংলাদেশ নিয়ে ১৯৭৫ সালে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অজানা নয় কারও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পাকিস্তান কনফেডারেশন তৈরির প্রস্তাব ও খসড়া তৈরি করেছিলেন পুতুল সরকারের প্রধান খন্দকার মোশতাক। শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হলেও পাকিস্তান তার দোসরদের দিয়ে এই দেশের ভবিষ্যৎকে তিলে তিলে হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যেই দেশের তরুণদের হাত ধরে স্বাধীন হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সেই তরুণদের হাত ধরেই আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছি আমরা। বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়নি পাকিস্তানে কখনই। ১৯৭১ সালের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে তা বারবার ধ্বংস করেছে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সেটা কখনও সামরিক বল প্রয়োগ করে, আবার কখনও সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে। সম্প্রতি ইমরান খানের গ্রেফতার ঘিরে আবারও ফুঁসে উঠেছে দেশটির মধ্যবিত্ত। এবার কি হবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম