মতামত

ভূত প্রেত নেই চিৎকার দিতে হলো কেন?

কোনো বিষয়ে চিৎকার দেওয়ার নানা কারণ লক্ষণীয়। সাধারণত কেউ হঠাৎ কোনো কিছু দেখে বেশি ভয় পেলে মূর্ছা যায়। আবার কেউ সাহস করে চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করে। বাচ্চারা ক্ষুধা পেলে চিৎকার করে, মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বা ডাকার জন্য হাউমাউ করে কাঁদে।

Advertisement

কেউ বিপদে পড়লে সময়মতো চিৎকার করার সুফল অনেক। এতে জীবন রক্ষা করা সহজ হয়ে উঠতে পারে। কিছু মানুষ অধিকারহারা হয়ে গেলে হতভম্ব হয়ে যায়। এতে কেউ লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে কেউ প্রতিবাদ করে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। চিৎকার দিলে সাহায্যকারীরা দ্রুত ভিকটিমের কাছে চলে এসে উদ্ধার তৎপরতা দেখাতে পারে।

সম্প্রতি ভোটকেন্দ্রে এসে কোনো ভোটার ভোট দিতে না পারলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে দিয়েছেন, ‘কোনো ভোটার যদি ভোট দিতে না পারেন তাহলে চিৎকার দেবেন। আমরা সেখান থেকে বসে ব্যবস্থা নিবো’। তিনি বলেন, ‘আমরা দুইটা পদ্ধতি বিশ্বাস করি। শরিয়ত ও মারফত। শরিয়তের পদ্ধতিতে ভোট কোথাও যায় না। কিন্তু এখন মারফতের পদ্ধতিতে এখানে ভোট দিলে ওখানে চলে যায় নিশ্চয়তা আমি বলতে পারবো না। কারণ আমি মারফত বুঝি কম। কাজেই শরিয়তের পদ্ধতিতে কোনোভাবেই একজনের ভোট অন্যজন দিতে পারে না’। (ইত্তেফাক জুন ১০ ২০২৩)। তিনি আরও বলেছেন, ‘ইভিএমে কোনো ভূত-প্রেত নেই। এটা সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। সকল বিচার বিশ্লেষণ করে কিছু পাওয়া যায়নি। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমি নিজেই এর দায়ভার নিবো।’ এসব কথাই সুষ্ঠুভোট অনুষ্ঠানের তাগিদে ভোটারদের জন্য বেশ আশাপ্রদ মনে হয়েছে।

এরই মাঝে দক্ষিণের খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। কমিশনের মতে বিচ্ছিন্ন সামান্য ঘটনা ছাড়া খুব ভালোভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। একজন সম্মানিত মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে হাতাহাতি, মুখে আঘাত, ঘুসি ইত্যদির ফলে দাঁত নড়বড়ে হয়ে যাওয়া রক্ত ঝড়ানোর ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে সেটাকে নিতান্ত গৌণ বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়ায় ফলাফল প্রকাশে না দেরি করে গাজীপুর সিটির মতো সমালোচনা এড়ানোর চেষ্টায় সফল হওয়া গেছে। কিন্তু ওই দলের প্রার্থী-সমর্থকরা ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। দলের প্রার্থীরা পরবর্তী রাজশাহী ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনগুলোতে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছেন।

Advertisement

মূলত ওই দলের প্রার্থী একজন সুপরিচিত ব্যক্তি। ধর্মীয় বিশ্বাসে অটুট, অত্যন্ত নীতিবান ও ন্যায়ভিত্তিক কাজের প্রতি সজাগ তিনি। ভোটের দিন কেন্দ্রে পরিদর্শনরত থাকা অবস্থায় বিপদ আঁচ করে প্রতিবাদ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ইভিএম মেশিনের দুপাশের সারিবদ্ধ বহিরাগত দেখে তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- তারা এতজন কেন কীভাবে সেখানে ঢুকেছেন! (প্রার্থীর ভিডিও সাক্ষাৎকার থেকে বক্তব্য)।

তিনি উপস্থিত আনসার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে অভিযোগ করলে তারা বলেছেন, এটি প্রিসাইডিং অফিসার জানেন, আমরা জানি না। প্রিসাইডিং অফিসার কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিরুত্তর থাকেন।.. এমন ঘটনা তিনি কয়েকটি কেন্দ্রে দেখার পর প্রতিবাদ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কয়েকজন সমর্থককে সাথে নিয়ে তিনি প্রতিবাদ তথা সিইসির-মতে, ‘ভোট দিতে না পারলে চিৎকার দেবেন’- সেই পরামর্শ ফলাতে চেয়েছেন। কিন্তু বিপদের কথাটি চিৎকার করে কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাতে গিয়ে মেয়র প্রার্থী নিজেই নাজেহাল হয়েছিলেন। কেন্দ্রে থেকে বের হওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে সরাসরি আক্রমণ করে বসে।

বরিশালের একজন মেয়রপ্রার্থীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, তিনি ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষের ভেতরে বহিরাগতদের ভিড় করতে দেখেছেন। যারা ভোটারদের প্রভাবিত করছিল। কোন ভোটার সেখানে ঢুকলেই মেশিনের বোতামে তার হাত চেপে ধরে ব্যালট পেপার খুলে নিতেন। এরপর মার্কা তালিকা বের হলে জোর করে ভোটারের আঙুল নিজেদের পছন্দনীয় মার্কার ওপর চেপে নিতেন। ভোটাররা ইভিএম নিয়ে একবারেই নতুন বা অজ্ঞ হওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ভোট দেওয়া হয়ে যাচ্ছিল।

এটাই ইভিএম ভোটের সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত হলে তার আঙুল টেনে ‘ব্যালট পেপার উন্মুক্ত করে নিয়ে গোপন কক্ষে অবস্থানরত মাস্তান বা ভূতেরা নিজরাই পছন্দনীয় মার্কার ওপরে জোর করে নিজের আঙুল বসিয়ে ভোট দিতে পারেন! এটাই ঘটানো হচ্ছিল এবং এ ব্যাপারেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে চিৎকার দিচ্ছিলেন প্রার্থী।’

Advertisement

তাই গোপন কক্ষে মেশিনের পেছনের বহিরাগত বা অনাহুত মানুষটিকে ‘ইভিএম ভূত’ বলে সারা বিশ্বে ইভিএম ভোটের বিরোধিতা করা হচ্ছে। ‘বিশ্বের ১২০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যেও ইভিএম বিতর্ক রয়েছে। এমনকি উন্নত প্রযুক্তির দেশ হয়েও অনেকে এখনও ইভিএম ব্যবহারে সাহস করছে না।’ অথচ আমাদের দেশে বহু অজ্ঞ ভোটার থাকা সত্ত্বেও ইভিএমে ভোট গ্রহণের দুঃসাহস ও কাড়ি কাড়ি টাকা অপচয় করার ফন্দি করা হয়েছে। তবে আশার কথা যে, সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলেও জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ‘ভূত’ থাকবে না।

ইভিএম মেশিনের নিজের কোনো দোষ নেই। দোষ করে মেশিনের পাশে থাকা দুষ্টু মানুষেরা। এ ব্যাপারে ড. মো. মাহফুজুল ইসলাম (অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগ, বুয়েট এবং সদস্য, ইভিএম উদ্ভাবন ও কারিগরি কমিটি) তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যে জনগণ ক্ষমতার উৎস, সেই জনগণই যখন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কোনো মাস্তানকে ভোটগ্রহণের সুযোগ করে দেয়, তখন ইভিএমের পক্ষে কিছু করার থাকে না।

তাই জনগণ সচেতন হলে এ ধরনের গোপন কক্ষে ভোট কারচুপি দূর করা সময়ের ব্যাপার, যা আগের ব্যালট পেপার পদ্ধতিতে সম্ভব ছিল না। সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইভিএম পদ্ধতিতে কোনো ধরনের ভোট কারচুপি করা যায় না এবং কেন্দ্র দখল করা যায় না। এটাও কোনো দুর্বোধ্য বিষয় নয় যে, গোপন কক্ষে ভোট কারচুপির জন্য ইভিএমকে দায়ী করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।’

কিন্তু অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘ইভিএমে একবার ভোট দিলে ওই ভোটারের পক্ষে আর কোনোভাবেই আবার ভোট দেওয়া সম্ভব হয় না। ইলেকট্রনিক ব্যালট গোপন কক্ষে স্থাপন করা হয়, যাতে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী ভোটার কাকে ভোট দিল, তা অন্য কেউ দেখতে না পারে। কিন্তু গোপন কক্ষে যদি আগে থেকে কোনো মাস্তান অবস্থান করে এবং ইলেকট্রনিক ব্যালট উন্মুক্ত হলে ভোটার ভোট দেওয়ার আগেই ওই মাস্তান ভোট দিয়ে দেয়, তখন ইভিএম মেশিনের কিছু করার ক্ষমতা থাকে না।’ (নিউজবাংলা২৪; জুলাই ২৮ ২০২২)।

গণতন্ত্রে চিৎকার করে কথা বলার নিয়ম থাকলেও সেই চিৎকারের মধ্যে একট শালীনতা বজায় রাখতে হয়। কিন্তু এমন নিয়ন্ত্রণহীন নাজুক অবস্থা তৈরি হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে কেউ কেউ চিৎকার দেওয়ার সময়-সুযোগও পান না। এজন্য ভোটাররা আগের নির্বাচন থেকে কেন্দ্রের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোটারশূন্য ভোটকেন্দ্র বড় বেমানান। তাই অবশ্যই ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে হবে। ভোটারের আঙুলের পরশ ছাড়া মেশিনে ব্যালট পেপার ভাসে না।

পর্দায় ব্যালট ভেসে উঠলেই পাশে থাকা যে কেউ পছন্দনীয় মার্কায় ভোট দিয়ে ফেলতে পারে। এজন্য গোপন কক্ষে ভোটারের পাশে থাকা বহিরাগত লোকটি বিপজ্জনক! কিন্তু ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে যদি গোপন কক্ষে আগে থেকে ওত পেতে থাকা ভোট চোর বা ভোট ভূতদের কবলে পড়ে নিজের আঙুলের ছাপে ব্যালট ওপেন করা সত্ত্বেও নিজের ভোট আরেকজন আগেই দিয়ে দেয় তাহলে উপায় কি?

ইভিএমে ভোট প্রদান নিয়ে এই দুরভিসন্ধি বা দুর্বলতার বিষয়টি আয়েজকরা নিশ্চয়ই জানেন। তাই তারা শুধু ভোটকেন্দ্রের বাইরের ছবি সিসি ক্যামেরায় দেখে ঢাকা থেকে পাহারা দেন। কিন্তু গোপন কক্ষের ভেতরে বহিরাগত থাকার বা নাজুক অবস্থা জানার জন্য সেখানে গোপন সিসি ক্যামেরা কই? সরিষার মধ্যে ভূত রেখে ভোটারদের সঙ্গে চরম প্রতারণা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা হয়নি। সেজন্য বরিশাল-খুলনা সিটির নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই।

এছাড়া কমিশনারের সিলেট সভার পরামর্শ অনুযায়ী একজন মেয়র প্রার্থী ভোটকেন্দ্রে গোপন কক্ষে মাস্তান দেখে চিৎকার দেওয়ার পরবর্তী ঘটনা শুনে দেশবাসী খুবই মর্মাহত। যখন একজন সিইসি বলেন, ‘তার কি রক্তপাত হয়েছে? রক্তপাত হওয়াটা আপেক্ষিক। তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন?’ এসব কথা শুনে মনে হয়েছে তিনি মোটেও স্বাভাবিক ছিলেন না। এমন নিষ্ঠুর ও হঠকারী মন্তব্য করার জন্য সিইসি হিসেবে এত গুরুদায়িত্ব পালন করা তার উচিত নয়।

দেশের সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা ও চরম অনৈতিকতা আমাদের একটি তোয়াজ-তোষণকারী দুর্বল জাতি হিসেবে দিন দিন অতি নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে এত উন্নয়ন করার পরেও আমাদের উন্নয়নের বরকত তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবন সংগ্রামের মতো উন্নয়ন সংগ্রামে সততার শক্তি কই? বুকের নৈতিক শক্তি হারিয়ে শুধু মুখের বাহাদুরিতে অতিকথন দিয়ে টেকসই উন্নয়ন করা যায় না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/জেআইএম