ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামী ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক বিরল সম্মান পেতে চলেছেন, যা তাকে উইনস্টন চার্চিল বা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে এক কাতারে বসিয়ে দেবে। মূলত সেদিন দুপুরে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দ্বিতীয়বারের মতো ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে মোদীর, যে গৌরব চার্চিল, ম্যান্ডেলা বা হাল আমলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ছাড়া আর কেউই পাননি।
Advertisement
শুধু তা-ই নয়, এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্টলেডি জিল বাইডেনের আমন্ত্রণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার হোয়াইট হাউসে আপ্যায়িত করা হবে। নরেন্দ্র মোদীর সম্মানে বাইডেন দম্পতি শুধু নৈশভোজই দিচ্ছেন না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে একান্তে ও প্রতিনিধি পর্যায়ে একাধিকবার বৈঠকেও বসছেন।
দিল্লি ও ওয়াশিংটনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সফরকে ভারত যে একটি ‘মাইলস্টোন’ বলে বর্ণনা করছে, তাতে তা-ই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ও আসন্ন এই সফরের পটভূমিতে লিখেছে, ভারত যদিও পশ্চিমাদের পছন্দ করে না, তবু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তারা আজ অপরিহার্য। আর মোদীর এই সফরে তারই প্রতিফলন ঘটতে চলেছে।
Advertisement
India does not love the West. But America needs it—and the two countries’ relationship may be the most important transaction of the 21st century https://t.co/oGBedf5U1z pic.twitter.com/YZRGUQkCZH
— The Economist (@TheEconomist) June 15, 2023প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, চীনের বিরুদ্ধে একটি ‘প্রতিরোধ’ (বুলওয়ার্ক) গড়ে তোলার জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের আজ যতটা প্রয়োজন, ততটা আগে কখনোই ছিল না।
এর আগে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক স্তরে অন্তত ছয়বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু ধারে ও ভারে তার আগের যেকোনো সফরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে এবারেরটি।
ফলে আগামী ২১ থেকে ২৩ জুন যুক্রাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদীর তিন দিনব্যাপী এই সফরের দিকে শুধু ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, নজর থাকবে গোটা বিশ্বেরই।
Advertisement
আলোচনা হবে যা নিয়েভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াটরা সোমবার (১৯ জুন) দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মোদীর এই সফরের আলোচ্যসূচিতে কী কী থাকতে পারে, তার একটি সম্ভাব্য রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
তিনি জানান, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার একটা প্রভাব অবশ্যই এই সফরে পড়বে। নরেন্দ্র মোদী ও জো বাইডেনের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও একটা ‘লিডারশিপ কানেকশন’ গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে তিনটি বিষয়– বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রতিরক্ষা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যেসব বিষয়ে সমঝোতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হলো ১৮০ কোটি ডলারের ১৮টি প্রিডেটর-বি আর্মড ড্রোন ক্রয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই ড্রোনগুলো দুর্গম সীমান্ত বা সামুদ্রিক এলাকায় দূর থেকেও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে এবং নজরদারি চালাতে পারে।
ভারতের তৈরি তেজস লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট। ছবি সংগৃহীত
পাশাপাশি, যৌথভাবে যুদ্ধবিমানের (ফাইটার জেট) ইঞ্জিন বানানোর জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হতে পারে। এই চুক্তি হলে ম্যাসাচুসেটসের এ্যারোস্পেস ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি (জিই) ও ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্থান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (হ্যাল) একসঙ্গে তেজস লাইট এয়ারক্র্যাফটের ইঞ্জিন বানাতে পারবে।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এসব প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে মরিয়া বলেই ইউক্রেন কিংবা ভারতে গণতন্ত্রের অধঃগতি সম্পর্কে মোদীর সফরে তারা নীরব থাকবে।
তাদের ভাষায়, তেলের জন্য তৃষ্ণার্ত ভারত যেভাবে রাশিয়ার যুদ্ধ-অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ ততটা করেনি। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার র্যাংকিংয়েও ভারত যতটা নিচে নেমেছে, ততটা খুব কম দেশই নেমেছে। কিন্তু তারপরেও নরেন্দ্র মোদী ওয়াশিংটনে রাজসিক অভ্যর্থনা পাবেন এবং সেই উচ্ছ্বাসে এসব অস্বস্তিকর প্রসঙ্গের অবতারণা হবে না।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসবে?বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধাপ্রদানকারীদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মোদী ও বাইডেনের আলোচনায় সেই প্রসঙ্গ আসবে কি না ভারত সরাসরি তার কোনো জবাব দেয়নি।
তবে মিয়ানমার সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে এদিন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো বিষয় নিয়েই দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হতে পারে। ঠিক কোন কোন ইস্যুতে তারা কথা বলবেন, তা নিয়ে আগেভাগে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।
তবে দিল্লিতে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থে’ যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে দিল্লি তাদের মনোভাব অবশ্যই ওয়াশিংটনের কাছে তুলে ধরবে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এজেন্ডায় দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা দুই দেশের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। ফাইল ছবি
বিবিসি বাংলা আরও জানতে পেরেছে, নরেন্দ্র মোদীর সম্মানে বাইডেন দম্পতি হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে যে নৈশভোজ এবং আলাদাভাবে যে সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন, তার দুটিতেই ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মুহাম্মদ ইমরান এর আগে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ মোদী সরকারের বহু কর্মকর্তা ও নীতি-নির্ধারকের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় রয়েছে।
কূটনৈতিক মহলের অভিমত, বাংলাদেশকে হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানগুলোতে (এবং সেই সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশনে) আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে দিয়ে এটি স্পষ্ট যে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় বাংলাদেশের ছায়া পড়বেই।
গত সপ্তাহে দিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠকেও বাংলাদেশে মার্কিন ভিসা-নীতির প্রসঙ্গ উঠেছিল বলে ভারতের সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
দেশটির একটি প্রথম সারির দৈনিক ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা এই (দক্ষিণ এশিয়া) অঞ্চলে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সেই রিপোর্ট স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি। তবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ‘অতি-সক্রিয়তা’ যে দিল্লি খুব সহজভাবে নিচ্ছে না, সেই ইঙ্গিত নানাভাবেই পাওয়া যাচ্ছে।
ফলে এ সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদী ও জো বাইডেনের মধ্যে বৈঠকগুলোতে সেই প্রসঙ্গের অবতারণা হওয়াটা তাই শুধু প্রত্যাশিত নয়, একরকম অবধারিতই বটে।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/