আমি একটু বোকা ধরনের মানুষ। মনে করি, যেটা আমার দরকার, সেটা যদি ন্যায্য হয়; তবে সেটা চাইতে হবে কেন। সেটা তো এমনিতেও পাওয়া উচিত, পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দাবি যতই ন্যায্য হোক, সেটা চাইতে হবে, প্রয়োজনে আদায় করতে হবে। আর চাহিদা এবং ন্যায্যতা বিষয়টাও আপেক্ষিক। কারও চাহিদা দু’বেলা দু’মুঠো ভাত। কারও চাহিদা বিকেলে ফাইভস্টার হোটেলে আড্ডা।
Advertisement
আমাদের সৃষ্টিকর্তা, যিনি অন্তর্যামী; তার কাছেও কিন্তু আমাদের চাইতে হয়। শিশু না কাঁদলে নাকি মাও দুধ দেয় না। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।' বঙ্গবন্ধু মহান বলেই ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, এমনকি ন্যায্য কথা একজন মানুষ বললেও তার পক্ষে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন আর কেউ ন্যায্যতার কথা বলেন না, ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়ান না। এখন গায়ের জোরে বা কখনো কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেও দাবি আদায় হয়ে যায়; সেই দাবি ন্যায্য হোক বা অন্যায্য।
বিভিন্ন সময়ে বিরোধীরা আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নেয়। বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন যে কোনো দাবিকেই এক ধরনের ন্যায্যতা দেয়। যেমন কদিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। আমি বরাবরই কোটার পক্ষের মানুষ। কিন্তু তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ কোটার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা বাতিল করে দিয়েছিল। তখন আমার কাছে কোটাকে ন্যায্য মনে হলেও অধিকাংশ মানুষের আবেগের কাছে হার মানতে হয়েছিল সরকারকে।
আবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার কঠোর আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়েছিল। আরেকটু পেছনে যদি যাই, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তানিরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ৬৯এর পথ ধরেই আসে ৭০এর নির্বাচন, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ। স্বৈরাচার এরশাদ বাংলাদেশের বুকে চেপে বসেছিল। ৯ বছরের আন্দোলন শেষে সাফল্য এসেছিল। ৯০এর গণআন্দোলনে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন এরশাদ। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে আন্দোলন করে দাবি আদায়ের ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। আন্দোলনে সফল্যের প্রথম এবং একমাত্র সূত্র হলো, জনগণের অংশগ্রহণ। যত বেশি জনগণের অংশগ্রহণ, আন্দোলনের সাফল্যের সম্ভাবনা তত বেশি।
Advertisement
বিএনপি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হেরে যায় বিএনপি। তারপর থেকেই মূলত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, এ অবস্থান নিয়ে বিএনপি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। শুধু বর্জন করেই বসে থাকেনি, নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ব্যাপক সহিংসতাও করে বিএনপি ও জামায়াত। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, ঠেকাতে পারেনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসাও।
নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু পরে দেখা যায়, তারা আসলে নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশ নেয়। জয় নয়, বিএনপির মূল লক্ষ্য ছিল দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা প্রমাণ করা। সেটা তারা ভালোভাবেই প্রমাণ করতে পেরেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এবং ২০১৮ সালে অংশ নেওয়ার কারণে; তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে ফিরে আসে।
বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা ছিল সাহসী, খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল আপসহীন। কিন্তু সেই দলটিই আজ আন্দোলনের মাঠে বিবর্ণ, হাসির পাত্র। অন্য সব ইস্যু যাই হোক, বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে বিতারণ, এমনকি খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পরও বিএনপি কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
কখনো নির্বাচন বর্জন, কখনো অংশগ্রহণ, কখনো ২০ দলীয় জোট, কখনো ঐক্যফ্রন্ট, কখনো যুগপৎ আন্দোলন, কখনো জামায়াতসহ, কখনো জামায়াত ছাড়া, কখনো সংসদে যোগদান, কখনো পদত্যাগ- ইত্যকার অধারাবাহিকতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপির আন্দোলন দানা বাধতে পারেনি কখনো। ফলে একদা সাহসী বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বলা হয়- কোন ঈদের পর আন্দোলন। গত ১৪ বছরে বারবার এই কথাটি সামনে এসেছে।
Advertisement
আগেই বলেছি, আন্দোলনের দাবি যৌক্তিক না অযৌক্তিক, ন্যায্য না অন্যায্য; তারচেয়ে বড় কথা হলো, তাতে জনগণের সমর্থন আছে কি না। তবে ন্যায্যতাটাও আপেক্ষিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কারও কাছে ন্যায্য দাবি, কারও কাছে হয়তো নয়। যেমন আজ আওয়ামী লীগের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক মনে হলেও ১৯৯৬ সালে তারাই তীব্র আন্দোলন করে বিএনপির কাছ থেকে দাবিটি আদায় করে ছেড়েছিল। আর আজ যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছে না, সেদিন কিন্তু তারা এর বিপক্ষে ছিল।
আন্দোলনের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই। কিন্তু এত কিছুর পরও বিএনপি দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কয়েক মাসের আন্দোলনে বিএনপিকে কাবু করে ফেলতে পেরেছিল। কিন্তু বিএনপি বছরের পর বছর চেষ্টা করেও আন্দোলন জমাতে পারেনি। আন্দোলনে ব্যর্থতার অজুহাত হিসেবে বিএনপি সরকারের দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা, গুম-খুনকে দায়ী করে। কিন্তু শুধু বর্তমান সরকার নয়, সব সরকারের আমলেই এটা সত্যি।
কোনো সরকারই চায় না, বিরোধী দল তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সফল হোক। আইয়ুব খান চায়নি, তবু গণঅভ্যুত্থান হয়েছে; এরশাদ চায়নি, তবু গণআন্দোলনে তার পতন হয়েছে। সরকার কী চাইলো না চাইলো, সরকার কতটা নির্যাতন-নিপীড়ন চালালো; তাতে তো আন্দোলন থেমে থাকবে না। আন্দোলন এগোনোর কথা তার নিজস্ব ধারায়। কিন্তু গত ১৪ বছরে সেই ধারাটিই ঠিক করতে পারেনি বিএনপি।
এই ১৪ বছরে বিএনপি আন্দোলনের মাঠে সবচেয়ে সফল ছিল গত বছরের দ্বিতীয় ভাগে। দেশজুড়ে নানান কর্মসূচি, বিভাগীয় সমাবেশে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু নির্বাচনের দেড় বছর আগে শুরু করা আন্দোলনের মোমেন্টাম ধরে রাখা যে কঠিন, সেটা এতদিনে বুঝে গেছে বিএনপিও। তাই তো নির্বাচনের যখন মাত্র ৬-৭ মাস বাকি তখন আন্দোলনের মাঠে নেই বিএনপি।
দেশের মাঠে সক্রিয় না থাকলেও বিদেশে লবিংয়ে দারুণ ব্যস্ত বিএনপি। আন্দোলন ও দেশের মানুষের ওপর ভরসা করতে না পারা বিদেশি বিভিন্ন শক্তির কাছে নির্বাচন নিয়ে ধরনা দিচ্ছে। সেখানে তারা দারুণ সফল। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে তারা। কিন্তু সমস্যা হলো, বিদেশি শক্তিগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে তারা নীরব। কারণ বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এ ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থাটি যদি ভালো হতো, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের দেশে এটা চালু করছে না কেন?
নির্বাচনের যখন মাত্র ৬-৭ মাস বাকি, তখন বিএনপিকে বেশ নির্ভার লাগছে। মাঠে আন্দোলন নেই, আন্দোলন গড়ার চেষ্টাও নেই। আরেকটি ঈদ সামনে রেখে বলতে হয়- কোন ঈদের পর আন্দোলন? ঈদের পর বর্ষা আসবে, তারপর আসবে এইচএসসি পরীক্ষা; ততদিনে নির্বাচনের তফসিলের সময় হয়ে যাবে। বিদেশি শক্তিগুলো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বিএনপির দাবি বিএনপিকেই আদায় করতে হবে আন্দোলনের মাধ্যমে। তেমন কোনো আন্দোলন গড়তে না পারলে, জনগণকে মাঠে নামাতে না পারলে; বিদেশি শক্তির ভরসায় বসে থাকলে লাভ হবে না। সময় কিন্তু খুব বেশি নেই হাতে।
১৮ জুন, ২০২৩লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস