অর্থনীতি

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে হোঁচট, প্রভাব ফেলছে সুগন্ধি চাল

করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুসংবাদ ছিল কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছোঁয়া। ২০২০-২১ অর্থবছর ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়। মাঝে একটি বছর। এর মধ্যেই চিড় ধরেছে কৃষিপণ্য রপ্তানি আয়ের সে অর্জনে। বছরখানেক ধরে সুগন্ধি চাল রপ্তানিও বন্ধ। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে অন্য কৃষিপণ্যসহ রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার ওপর।

Advertisement

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস (জুলাই-মে) পর্যন্ত ৮০ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি ছিল ১১০ কোটি ডলারের। এ সময়ে কমে গেছে চা, তাজা সবজি, ফুল, ফল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার রপ্তানি।

আরও পড়ুন>> বছরে রপ্তানি হচ্ছে ১০ হাজার টন সুগন্ধি চাল

ইপিবির তথ্য বলছে, ১২ বছর আগেও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। শেষ ছয় বছর খাতটির রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ছিল। এর মধ্যে শুধু করোনার শুরুতে প্লেন বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি পাঁচ শতাংশ কমেছিল, যা পরের বছরই ভালো অবস্থানে যায়। এরপর এবছরই বড় হোঁচট খেতে যাচ্ছে এ খাতের রপ্তানি আয়।

Advertisement

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশকিছু কারণে কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে। দেশে অস্বাভাবিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে অন্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি সবজির মতো কৃষিপণ্যের দাম। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দামও বেশি। যে কারণে আটা, ময়দা, তেল, চিনির মতো পণ্যগুলোর মাধ্যমে তৈরি হিমায়িত খাবারের খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে রয়েছে ডলার সংকটে চলতি বছর কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, ব্যয় বাড়া, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি জটিলতা। পাশাপাশি দেশ থেকে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বন্ধ থাকায় সেই বাজার হারানো এবং সুগন্ধি চালের কারণে অন্য পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে।

আরও পড়ুন>> যুক্তরাজ্য-কানাডায় পোশাক রপ্তানি বেড়েছে, কমেছে যুক্তরাষ্ট্রে

কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুরজাতীয় শুকনা খাবার, ফলের রস (জুস), বিভিন্ন ধরনের মসলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি। শেষ ১১ মাসে কোম্পানিগুলো ২৩ কোটি ডলারের এ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা গত বছর একই সময়ে ২৭ কোটি ডলার ছিল। এটা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম।

এ ধরনের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। সংগঠনটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, স্নাক্সজাতীয় খাবারে আমরা এখন একদম পিছিয়ে গেছি। আমাদের দেশে আটা, ময়দা, তেল, চিনি, ডালডা এসবের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমাদের প্রতিযোগী ভারত-পাকিস্তানে এগুলোর দাম কম হওয়ায় তাদের খরচও কম। প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। বড় একটি অংশের অর্ডার হারাচ্ছি।

Advertisement

রপ্তানিকারকরা এ-ও বলছেন, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাড়তি ফ্রেইট চার্জ একটা বড় বাধা। ফ্রেইট চার্জের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। এটা একটা বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে পণ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানির বাজারে হোঁচট খাচ্ছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন>> প্রত্যাহার হচ্ছে সুগন্ধি চালের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা

বাপা জানায়, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান ২০টি। প্রাণ ও স্কয়ার গ্রুপ রপ্তানিতে বেশ এগিয়ে। সবমিলে রপ্তানি করছে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বর্তমানে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। তারপরও অধিকাংশ কোম্পানির রপ্তানি প্রবৃদ্ধি চলতি বছর কমেছে।

এ অর্থবছরের ১১ মাসে তাজা সবজি রপ্তানি কমেছে ৪০ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে মাত্র সাড়ে ৯ কোটি ডলারের সবজি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, আমরা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করি। সেখানে অ্যাভারেজ সবজির দাম থাকে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা। সেটা বাছাই ও প্যাকিংসহ। সেখানে দেশের বাজারেই এক কেজি সবজি ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গত ছয়মাসে কার্গো ভাড়া ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এজন্য রপ্তানি করে লাভ হচ্ছে না। আগ্রহ হারাচ্ছে সবাই।

সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ থাকায় এবছর সার্বিক রপ্তানি বেশ কমেছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারকরা বলছেন, কৃষিপণ্যের রপ্তানি ঝুড়ির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতো সুগন্ধি চাল। ওই চালের রপ্তানি গত জুলাই থেকে পুরোপুরি বন্ধ। যদিও সরকার পুনরায় এ চাল রপ্তানি খুলে দেওয়ার কথা ভাবছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) নেতৃত্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় এ নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে বন্ধের আগে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হতো। বিশ্বের ১৩৬টি দেশেই এই চাল রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে, যে বাজার প্রতি বছরই একটু একটু করে বাড়ছিল। কিন্তু এক বছর ধরে রপ্তানি বন্ধ থাকার কারণে এই বাজার হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করছেন রপ্তানিকারকরা। একই সঙ্গে নতুন করে রপ্তানি শুরু হওয়ার পরও আবার এই রপ্তানি বাজার পুনরুদ্ধার করা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন তারা।

সুগন্ধি চাল রপ্তানির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান। আর ক্রেতা দেশগুলো এসব দেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সুগন্ধি চালের সঙ্গে অন্য পণ্য একত্রে নেয়। ফলে সুগন্ধি চাল না দিতে পারায় বাংলাদেশের অর্ডারগুলো (ক্রয়াদেশ) যাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানে।

ইপিবি অন্য ক্যাটাগরিতে কৃষিপণ্যের একটা রপ্তানির হিসাব দেয়, যার মধ্যে ৩০ শতাংশই চালের রপ্তানি। এই ক্যাটাগরিতে রপ্তানি ১১ মাসে ৪৫ শতাংশ কমেছে, যা ৮১ কোটি ডলার থেকে এখন নেমেছে ৬৩ কোটি ডলারে।

এনএইচ/এএসএ/এমএস