গবাদিপশুর খাবারের বড় অংশের একটি জোগান আসে খড় থেকে। পাশাপাশি অনেকে সবুজ ঘাস ও দানাদার খাদ্য দিয়ে থাকেন পশুকে। তবে সহজেই মেলে খড়। এ খড় আসে বছরে তিনবার উৎপাদিত ধানগাছ থেকে। তবে পরিবহনের সুবিধার জন্য জমিতে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ খড় রেখেই ধান কেটে নিয়ে যান শ্রমিকরা। ফলে জমিতেই পড়ে থাকছে লাখ টাকার খড়।
Advertisement
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ইরি-বোরো, আউশ ও আমন চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় চার লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। প্রতি বছর এই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় কোটি টাকার খড় উৎপাদন হয় (বিঘাপ্রতি তিন হাজার টাকা হিসাবে)। খড়ের যে পরিমাণ অবশিষ্ট অংশ জমিতে পড়ে থাকে তার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
জেলা সদর, বদলগাছী, নিয়ামতপুর ও ধামইরহাটসহ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ইরি-বোরো ধান কাটা-মাড়াই প্রায় শেষ। মাঠ এখন ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ধান কেটে নেওয়ার পর প্রায় এক থেকে দেড় ফুট অবশিষ্ট খড় জমিতে রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও আরও বেশি পড়ে আছে। অনেকে আবার সেই খড় গবাদিপশুর জন্য কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আউশ ধানের বীজতলা তৈরিতে সেই খড় কেটে ফেলে দিচ্ছেন। যদি জমি থেকে সঠিক পরিমাণ খড় কাটা হয় তাহলে আপৎকালীন সময়ে গো-খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে।
এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে মাঠের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন চাষিরা। প্রতি বিঘা জমিতে ধান কাটতে কৃষকদের খচর পড়েছে প্রায় ৪-৫ হাজার টাকা। আবার কোথাও প্রতি মণে শ্রমিকরা মজুরির সঙ্গে নিয়েছেন ৬-৭ কেজি করে ধান। তবে বাড়তি মজুরি দেওয়ার পরও প্রায় অর্ধেক পরিমাণ খড় জমিতে রেখে ধান কেটেছেন শ্রমিকরা।
Advertisement
শ্রমিকরা জানান, ধানের গোড়া পর্যন্ত কাটা খড় ওজনে বেশি হয়। এতে জমি থেকে কাঁধে বা মাথায় বহন করা কষ্টসাধ্য। এছাড়া সময়ও বেশি লাগে। তাই বাধ্য হয়ে মাঝ বরাবর খড় কাটা হয়। তবে নিচ থেকে ধান কাটা হলে খড়ের পরিমাণ বেশি হতো।
আরও পড়ুন: গো-খাদ্যের দাম কমলেও বেড়েছে মাংসের
মান্দা উপজেলার চকবালু গ্রামের কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ১৮-২৫ পন (৮০ আঁটিতে এক পন) খড় পাওয়া যায়। পুরাতন খড় ২৫০-৪০০ টাকা পন এবং আকারে ছোট। আর নতুন খড় ১২০-১৫০ টাকা পন হিসেবে বিক্রি হয়। এক বিঘা জমিতে যে পরিমাণ খড় পাওয়া যায় তার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় তিন হাজার টাকা। জমিতে যে পরিমাণ খড় হয় তার প্রায় অর্ধেক মাঠেই থেকে যায়। বলা যায় প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার খড় জমিতেই থেকে যায়।
ধামইরহাট উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক সানাউল হক বলেন, ধান ছোট করে কাটলে শ্রমিক কম লাগে এবং পরিবহনে সুবিধা হয়। শ্রমিকরা ধান লম্বা করে কেটে দিতে চায় না এবং মজুরি বেশি নিতে চায়। অনেক সময় শ্রমিকও পাওয়া যায় না। এ বছর প্রতি মণে ৬-৭ কেজি করে ধান দিতে হয়েছে।
Advertisement
উপজেলার চকপ্রসাদ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বলেন, জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। খড়ের প্রায় অর্ধেক অংশ জমিতে থেকে গেছে। এখন নিজ থেকে কেটে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। মজুরি দিয়ে ধান কেটে নেওয়ার পরও এখন নিজেকে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এভাবে ধান কেটে নেওয়ায় খড়ও কম পাওয়া গেছে। বছর শেষে আবার খড় কিনে গরুকে খাওয়াতে হবে। অন্তত ৩-৪ হাজার টাকার খড় প্রতি বিঘা জমিতে থেকে গেছে।
আরও পড়ুন: ধু-ধু বালুচরে বাড়ছে আবাদি জমি, কমছে গো-চারণভূমি
একই গ্রামের কায়েম উদ্দিন বলেন, চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। ১২টি গরু আছে। খড় এভাবে কাটার কারণে বছর শেষে সংকটে পড়ে যাই। বছরে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকার খড় কিনতে হয়। গোড়া পর্যন্ত কাটা হলে খড় বেশি পাওয়া যেত। বছরে খড় কিনতে যে টাকা খরচ হয় তা সংসারের একটি অংশ চলে যায়। খড় কিনতে না হলে আর্থিকভাবে অনেকটা এগিয়ে যেতাম।
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ধান কাটার সময় ওপরের অংশ কাটা হলেও নিচের অংশ জমিতে থেকে যায়। এতে গবাদিপশুর আপৎকালীন বা সংকটকালীন যে খাদ্য সংকট হয় খামারি তা পূরণ করতে পারেন না। কৃষকদের পরামর্শ থাকবে- ধান কাটার সময় অবশ্যই ধানের গোড়া পর্যন্ত কাটতে হবে। এতে সারা বছর সংরক্ষণ করে গবাদিপশুর খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, গবাদিপশু পালনের পাশাপাশি খামারিদের ঘাস চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
নওগাঁ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ধান কাটার পর জমিতে যে অংশ পড়ে থাকে তা জমির জন্য উপকারী। এসব খড় পচে পরে মাটির সঙ্গে জৈব সার তৈরি হয়। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আর গবাদিপশুর খাদ্যের জন্য যদি বলা হয় যতটুকু খড় কাটা প্রয়োজন তা কেটে বাকি অংশ জমিতে রাখা ভালো।
এফএ/এএইচ/এমএস