ভ্রমণ

বাংলার সুলতানি শাসনামলের গৌড়ের ১০ স্থাপত্য

রফিকুল ইসলাম জসিম

Advertisement

বাংলার সুলতানি আমলে ব্যাপকভাবে গৌড় নামটি পরিচিত হয়েছিল। দিল্লি থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের পরে পান্ডুয়া সুলতানাতের প্রথম রাজধানী হয় গৌড়। ১৪৫০ সালে, বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ পান্ডুয়া গৌড়কে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।

সেটি ১৪৫৩ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলার সুলতানিয়ানরা ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে গৌড়ের রাজধানীতে অবস্থান করেন। ১২০৫ সালে তুর্কি শাসকেরা বাংলা দখল করার পরেও বাংলার রাজধানী থেকে যায় গৌড়ই।

আরও পড়ুন: মাটির ১৩৭৫ ফুট গভীরে ঘুমাতে পারবেন ‘ডিপ স্লিপ হোটেলে’

Advertisement

শহরের নাম অবশ্য পাল্টে হয় লখনৌতি। ১৩৫০ থেকে রাজধানী কিছুদিনের জন্য পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত হলেও ১৪৫৩ সালে আবার রাজধানী ফিরে আসে গৌড়ে ও শহরটির নামকরণ হয় জান্নাতাবাদ।

এরপর প্রায় তিন শতক ধরে তুর্কি সুলতানরা গৌড়কে তাদের ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন ও সাজিয়ে তোলেন। মুঘল শাসকদের আমলেও সেখানে গড়ে উঠেছিল অসাধারণ সব স্থাপত্য।

বড় সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, লোটন মসজিদ, কদম রসুল মসজিদ, লুকোচুরি দরোয়াজা, ফিরোজ মিনার, চিকা মসজিদ, গুমতি দরওয়াজা, ফতেহ খানের সমাধি- সমস্ত মধ্যযুগ ধরে এখানে একের পর এক দৃষ্টিনন্দন সৌধ বানানো হয়েছে।

গৌড়ের স্থাপত্য ও কারুকার্য আজও সুলতানি দরবারের সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে সেইসব স্থাপত্যের কয়েকটি আলোচনা।

Advertisement

মালদা জেলার গৌড়

দ্বাদশ শতক থেকে ষষ্টদশ শতক পর্যন্ত সুবে বাংলার রাজধানী ছিল মালদা জেলার গৌড়। চার শতক ধরে গৌড় দেখেছে বহু রাজত্বের উত্থান ও পতন। ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ আজও স্মরণ করিয়ে দেয় সুদৃশ্য গ্রামীণ স্থাপত্য-ভাস্কর্যকে যেমন- বাইশ-গজি প্রাচীর।

আরও পড়ুন: প্রিয়জন নিয়ে ঘুরে আসুন ‘মেঘনা ভিলেজ হলিডে রিসোর্টে’

এককালে একে বলা হত গৌড়ের রক্ষাকবচ দুর্গ। এই স্থাপত্য বর্তমানে ক্রমশ মলিন ধুলোবালিতে পরিণত হচ্ছে। এই প্রাচীরের উচ্চতা ৬৬ ফুট বা ২২ গজ। সে কারণেই এর নাম হয়েছে ‘বাইশ-গজি’। এটি নির্মাণ করেছিলেন বরবাক শাহ। ১৪৫৯-১৪৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুবে বাংলার সুলতান।

বড় সোনা মসজিদ

বড় সোনা মসজিদ। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এটি অন্যতম বৃহত্তম স্থাপত্য। ১৫২৬ সালে এটির স্থাপনা করেছিলেন নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ। এই মসজিদে এক সময় ৪৪টি গম্বুজ ছিল, যার মধ্যে বর্তমানে ১১টি টিকে আছে।

বড় সোনা মসজিদের আর এক নাম বারো দুয়ারি, কারণ এর ১২টি দরজা রয়েছে। মজার বিষয় হলো, বারো দুয়ারি নাম হওয়া সত্ত্বেও এই মসজিদের পূর্ব দিকে আছে মোট ১১টি বিশাল দরজা।

আরও পড়ুন: ১০০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত হলো মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ

হাতি বাঁধা স্তম্ভ

গৌড়ের দুর্গ শহরে আগত দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায় দুটি সুসজ্জিত, অলংকৃত ও চিত্রিত স্তম্ভ। বড় সোনা মসজিদের পাথুরে স্তম্ভের সঙ্গে এই নির্মাণকাজের অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে।

ধারণা করা হয়, এই স্তম্ভগুলোও এক সময় মসজিদের অংশ ছিল। তবে কেউ জানে না, কবে ও কেন এগুলো মূল স্থান থেকে সরানো হয়েছিল। সম্ভবত হাতি বাঁধার জন্য এগুলো পরে ব্যবহৃত হত ও স্থানীয়রা এর নাম দেয় ‘হাতি বাঁধা স্তম্ভ’।

রামকেলি

প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে আছে রামকেলি। এটি মহাপ্রভু চৈতন্যকে উৎসর্গ করা একটি মঠ। এই ঐতিহাসিক শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র ধ্বংসাবশেষ ও স্মৃতিসৌধের মধ্যে এটাই একমাত্র সজীব হিন্দু ধর্মীয় স্থল।

এখানেই সুলতান হুসেন শাহের দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রূপ ও সনাতন গোস্বামী ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন চৈতন্যের। চৈতন্যের একটি মূর্তি ও একটি ছোট মন্দির আজও তাদের প্রথম সাক্ষাতের চিহ্ন বহন করে। এখন রামকেলি আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন: পাশের দেশে গিয়ে ঘুরে আসুন ‘ছোট্ট স্কটল্যান্ডে’

দাখিল দরওয়াজা

গৌড়ের দুর্গের যে তিনটি তোরণ আজও টিকে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল দাখিল দরওয়াজা। এটি সালামি দরওয়াজা নামেও পরিচিত। দুর্গে যখন কোনও বিশিষ্ট অতিথি আসতেন তখন এখান থেকে তাঁকে বন্দুক ছুঁড়ে স্যালুট জানানো হত, তাই এমন নাম।

এই ইমারতের মধ্যে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলি মিশ্রিত হয়েছে ও সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজও আছে এতে। আছে ফ্লোরাল ও জ্যামিতিক নকশা। দেওয়ালকে এই নকশা দিয়েই সাজানো হয়েছে। ইঁট দিয়ে নির্মিত এই তোরণ ও চার কোণে আছে চারটি মিনার।

ফিরোজ মিনার

পঞ্চদশ শতকে সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ নির্মাণ করেছিলেন ফিরোজ মিনার। পাঁচতলা বিশিষ্ট এটি এক বিজয়-স্তম্ভ। বরবাক শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করার পর এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

সেই স্মৃতি আজও বহন করছে এই ইমারত। এর উচ্চতা ৮৫ ফুট। এক সময় বিশালাকায় গম্বুজ ছিল যার উপর পরে সমতল ছাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: কম খরচেই ঘুরে আসুন মিরপুরের ‘তামান্না ওয়ার্ল্ড ফ্যামেলি পার্কে’

লুকোচুরি দরওয়াজা

রাজ দরবারের প্রবেশের জন্য ছিল ‘লুকোচুরি দরওয়াজা’। এটি শাহি দরওয়াজা নামেও পরিচিত। ত্রিতল বিশিষ্ট এই ইমারতে রয়েছে প্রহরা কক্ষ ও ড্রাম ঘর। ১৬৫৫ সালে এটি স্থাপিত হয়েছিল।

তবে, এই তোরণে আজও সূক্ষ্ম পলেস্তারা-কর্মের চিহ্ন রয়ে গেছে। এই তোরণের সমগ্র বাইরের অংশটা এক কালে আবৃত ছিল রঙিন মিনে করা এনামেলের টালি দিয়ে।

তাঁতিপুরা মসজিদ

তাঁতিপুরা মসজিদের নামটি এসেছে বাংলা শব্দ ‘তাঁতি’ থেকে। ১৪৭৪-১৪৮০ সালে মধ্যে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এই মসজিদের সঙ্গে স্থানীয় তাঁতি সম্প্রদায়ের গভীর যোগাযোগ ছিল। তাঁতিপুরা মসজিদে সুন্দর টেরাকোটার কাজ আছে।

গৌড়ে যতগুলো সুদৃশ্য মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে এই মসজিদের টেরাকোটার কাজ বিখ্যাত। তবে সময় বড় নির্মম। এক সময় ১১০টি গম্বুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত যেখানে আজ সেখানে একটাও গম্বুজ নেই। সবই এখন ইতিহাসের কোলর আশ্রয় নেওয়া স্মৃতি। পূর্ব দিকের দেওয়ালের একটা বড় অংশও ভেঙে পড়েছে।

আরও পড়ুন: যে দেশে কনে যায় বিয়ে করতে, ধূমপান করলেই হয় জেল

চামকাটি মসজিদ

চামকাটি মসজিদের এমন নাম হল কেন তা নিয়ে নানা রকম তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। কেউ মনে করেন, ‘চাম কাটি’ এসেছে ‘চামড়া কাটা’ থেকে। মনে করা হোয মুসলিম ‘লেদার’ শ্রমিকদের দেওয়া এই নাম।

আবার অনেকের বিশ্বাস, মসজিদের নাম ‘চামকাথি’ থেকে এসেছে যার অর্থ হল সংকীর্ণ প্রবেশ পথ। ১৪৭৫ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ।

বল্লাল বাটি

২০০৩ সালে বল্লাল বাটি খনন করা হয়েছিল ও তারপর থেকে গৌড়ের ধংসাবশেষের তালিকায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে রয়ে গিয়েছে। এই ইমারতের নির্মাণ-সাল বা তারিখ সম্বন্ধে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

কারও কারও মতে, সেন বংশের রাজপ্রাসাদের অংশ এটি। আবার অনেকে মনে করেন, পাল সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ স্তূপ আসলে এই ধ্বংসাবশেষ।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।

জেএমএস/এএসএম