বদিউল আলম মজুমদার। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর বাংলাদেশি শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
Advertisement
রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: ফের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কী ঘটবে আসন্ন নির্বাচনে?
বদিউল আলম মজুমদার: আমি আসলে জ্যোতিষী হলে আপনার এ প্রশ্নের উত্তর ভালো করে দিতে পারতাম। রাজনীতি নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। তবে আমার মনে হয়, মানুষের মধ্যে এক প্রকার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করা। মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সেই অধিকার মানুষ হারিয়ে ফেলছে বলে মনে করে। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এমন এক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যেখান থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে চায়।
Advertisement
আরও পড়ুন: ‘বিএনপি মাথা নিচু করে বুলেট এড়িয়ে চলছে’
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ১১টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। আর চারটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় এবং এই চারটি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তন হয়েছে। এই চারটি নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছিল এবং নির্বাচন অধিক নিরপেক্ষ হয়েছিল বলেই প্রমাণিত।
জাগো নিউজ: সামনের নির্বাচনে কী ঘটবে? কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
বদিউল আলম মজুমদার: সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর। নির্বাচন প্রক্রিয়া আসলে একদিনের বিষয় নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঠিকতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা এবং সাংবিধানিক কাঠামো যথাযথ কি না- এ তিনটি বিষয় নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Advertisement
প্রশ্ন হচ্ছে প্রক্রিয়াটা সঠিক করবে কে? নির্বাচন কমিশনের ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ ও নির্ভিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে তাহলে সুষ্ঠু হতে পারে। একইভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারকেও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে হবে। সরকার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করলে কেউ আর নিরপেক্ষ আচরণ করতে পারে না।
নির্দলীয় সরকার নির্বাচনী মাঠ সমতল করছিল বলেই চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে এবং ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে এমন নিরপেক্ষ মাঠ তৈরি করা সম্ভব নয়, এটি সাতবার প্রমাণিত। দলীয় সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনে পর্বতসম বাধা।
আরও পড়ুন>> শেখ হাসিনা বোল্ড লেডি, তিনি ভয় পান
ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ফল ঘোষণা পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াই দলীয় সরকার প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে এবং আমরা এখন তাই দেখছি। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চরমভাবে দলীয়। চরম দলীয় প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আর নির্বাচন কমিশন তো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে আসছে আগে থেকেই।
মনে রাখা দরকার বিশেষ সমঝোতার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল এবং সেই সমঝোতা এখন ভেঙে গেছে। সংবিধান সংশোধনের আগে গণভোট করার বিধান রয়েছে। তা করা হয়নি। আর এ কারণেই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ: তত্ত্বাবধায়ক সরকারই তো সংবিধানপরিপন্থি।
বদিউল আলম মজুমদার: আমার মতো অনেকেই মনে করেন সংবিধান লঙ্ঘন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছে। এ কারণেই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত বলে মনে করি। মধ্যরাতে ব্যালটবক্স ভর্তি করা হয়। ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারেনি।
জাগো নিউজ: মধ্যরাতে ভোট হয়েছে এটি আসলে সঠিক প্রমাণ মেলে না…
বদিউল আলম মজুমদার: বহু প্রমাণ আছে। বিবিসি ছবি প্রকাশ করেছে। টিআইবি ৫০টি আসনে দেখিয়েছে কীভাবে রাতে ভোট হয়েছিল। আমরা তথ্য নিয়ে দেখিয়েছি ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১২শ কেন্দ্রে বিএনপি শূন্য ভোট, দুটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের শূন্য ভোট, ৬শরও অধিক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগে শতভাগ ভোট পড়েছে।
আরও পড়ুন>> ‘সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষকেই জাগতে হবে’
জাগো নিউজ: ৪০ হাজারের অধিক কেন্দ্র। সেখানে এমন ত্রুটি থাকতেই পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: এই তথ্যগুলোই একটি নির্বাচনের সব দিক তুলে ধরে। অবিশ্বাস্য চিত্র এটি। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে আমরা এই চিত্র পেয়েছি। মামলা হয়েছে। বহু অভিযোগ পড়েছে। পাঁচবছর শেষ হতে যাচ্ছে। একটি অভিযোগেরও তদন্ত করেনি নির্বাচন কমিশন। মানুষ তো জানে ভোট নিয়ে আসলে কী ঘটেছে দেশে।
জাগো নিউজ: আপনারা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা অভিযোগ করছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো অভিযোগ নেই। মানুষ কিন্তু মেনে নিলো।
বদিউল আলম মজুমদার: মানুষের অভিযোগ করার ক্ষেত্র সীমিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দলীয় বাহিনীর মতো কাজ করছে। মানুষ কথা বলতে পারছে না বলেই তো আপনি একটি চরম ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলতে পারবেন না। আদালতেও তো মামলা হয়েছে। আদালতও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। আদালতের রায় অমান্য করে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ কারণেই এই সরকার অবৈধ বলে মনে করা হয়। এই সরকার আইনসিদ্ধ প্রক্রিয়ায়ও বৈধ নয়। মানুষ সরকারকে মেনে নিয়েছে, মনে নেয়নি।
জাগো নিউজ: মেনে নেয়নি এর প্রমাণ কী?
বদিউল আলম মজুমদার: প্রমাণ হচ্ছে সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে। ভয় না পেলে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতো, মানুষের দাবি মেনে নিতো।
জাগো নিউজ: সরকার তো যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইবে। জনচাপ না থাকলে ক্ষমতা কেউ হারাতে চায় না। সরকার তো সেই অর্থে চাপে নেই?
বদিউল আলম মজুমদার: জনচাপ আছে। সরকার, দল আর আমলারা একাকার হয়েছে। মানুষের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি একটি রাষ্ট্র, সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম