প্রকৃত নাম এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা। তবে বিশ্ব তাকে চেনে লা চে, কেবল চে বা চে গুয়েভারা নামেই। চে গুয়েভারা ছিলেন এক বরেণ্য আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব।
Advertisement
মৃত্যুর পর তার মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত হয়। যা ক্রমে বিপ্লব-প্রতিবাদের বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। চে গুয়েভারার জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায়। চিকিৎসক থেকে একজন বিপ্লবী হয়ে ওঠেন তিনি। জীবন ছিল রমাঞ্চ দিয়ে ভরপুর। আজ আমরা চে গুয়েভারার একজন চিকিৎসক থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠার সেই রমাঞ্চকর গল্পই জানব।
পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বয়োজ্যেষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বহমান।
শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তার ভেতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন। তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রবাদীদের একজন গোড়া সমর্থক, সেই সংঘর্ষের সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে দিতেন।
Advertisement
১৯৪৮ সালে বুয়েনোস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবের্তো গ্রানাদো নমক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পুয়েবলোর কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ বসতিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজ করা।
তার ভ্রমণের পরবর্তী সময়ে তিনি কুষ্ঠরোগীদের বসতিতে বসবাসকারী মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহচার্য দেখে অভিভূত হন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তার দিনলিপি ‘দ্য মটোরসাইকেল ডাইরিসে’ তিনি লিখেছেন, ‘মানব সত্তার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রূপটি এ সকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে’। তার এই দিনলিপি নিউয়র্ক টাইমস-এর ‘বেস্ট সেলার’ তালিকায় স্থান পায় এবং পরে একই নামে চলচ্চিত্র বের হয়, যা পুরস্কৃত হয়েছিল কয়েকটি জায়গায়।
১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে গেভারা মেক্সিকো নগরীতে পৌঁছান এবং সদর হাসপাতালে অতিপ্রতিক্রিয়া (অ্যালার্জি) বিভাগে চাকরি করেন। পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতে চিকিৎসা বিষয়ে প্রভাষক এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করতেন। এসময় তার পরিচয় হয় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। তার কিছুদিন পরই ১৯৫৫ সালের ২৬ জুলাই তিনি আন্দোলন দলে যোগ দেন।
বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো থেকে কিউবায় আক্রমণ চালানো। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ করে। সে যাত্রায় তাদের দলের মাত্র ২২জন বেঁচে যায়। তারমধ্যে চে গুয়েভারাও ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় তিনি তার চিকিৎসাসামগ্রীর সঙ্গে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়েছিলেন। যা তাকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করল!
Advertisement
ওটাই ছিল সেই সন্ধিক্ষণ। যে লগ্নে এক তরুণ চিকিত্সকের মনে জন্ম নিল এক বিপ্লবী! অথচ বিপ্লব তো দূরের কথা, চিকিৎসক হওয়ার কথাও কোনোদিন ভাবেননি চে। তার নেশা ছিল খেলাধুলা আর কবিতা। ১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন বাবার কাছে। স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেও শুরু করেন। এছাড়া সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং সবই করতেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নেরও সদস্য ছিলেন। বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাগবি দলের হয়ে খেলেছেনও। তবে চে গুয়েভারা সবচেয়ে মুগ্ধ ছিলেন সাইক্লিংয়ে।
সারা জীবন চে কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান অনেকেই তার মনে ও মননে স্বপ্ন ও কল্পনার মায়াজাল বুনে দিয়েছিল। তিনি ভালো আবৃত্তিও পারতেন।
লাতিন আমেরিকায় ভ্রমণের সময় থেকেই তার মনে বিপ্লবেরর একটা অঙ্কুর জাগ্রত হতে থাকে। সেসময় তিনি মানুষের দারিদ্র্য দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং এর একমাত্র সমাধান বিশ্ববিপ্লব। ধীরে ধীরে এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমে তার জীবনের গতিপথ বদলায়। আদর্শ পাল্টটায়। তিনি স্টেথো ছেড়ে বন্দুক তুলে নেন।
চে গুয়েভারাকে কিউবান ভাষায় লেখালেখিও করেছেন। লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর মতো। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে ৭০টির মতো পাওয়া যায়। তার লেখালেখি নিয়ে রচনাবলিও প্রকাশিত হয়েছে।
বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর চে-কে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর দুপুর ১.১০টার দিকে। মৃত্যুর সময়কাল ও ধরন নিয়ে রয়েছে মতভেদ ও রহস্য। ধারণা করা হয়, ১৯৬৭ সালের কোনো একদিন লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দি চে গুয়েভারাকে।
তার মৃত্যুর খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে: আবার চে গুয়েভারার মৃত্যু হয়েছে এবং সত্যিই তাই ঘটেছে বলে মনে করে সবাই। এর কারণ তার মৃত্যু নিয়ে নানান ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। গুলি করে হত্যা করার পরের দিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ একটি নিবন্ধের তৃতীয় লাইনটি ছিল এমন, ‘৩৯ বছর বয়সী মি. গুয়েভারা এর আগেও মারা গিয়েছিলেন বা বন্দি হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।’ মৃত্যুর পর বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃতদেহ প্রদর্শন করা হয়েছিল। এরপর গোপনে একটি গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়।
এর ঠিক ৩০ বছর পর, জন লি অ্যান্ডারসন যখন গুয়েভারার জীবনী লেখবেন বলে ঠিক করলেন, তার কবরটি কোথায় সেটা জানা জরুরি হয়ে যায়। তখনই খুঁজে বের করা হয় তার কবর এবং দ্বিতীয়বারের মতো কিউবায় পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে তার সমাহিতকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা। তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা, নাটক। ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বরে মায়ামি বিচে আর্ট ব্যাসল চলচ্চিত্র উৎসবে চে পার্ট ওয়ান চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হয়। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে ২৪ জানুয়ারি জীবনী, নাটক, ইতিহাস এবং যুদ্ধনির্ভর এ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় আমেরিকাতে। স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এ মুভিটিতে অভিনয় করেন চে এর ভূমিকায় ছিলেন বেনেসিও ডেল টরো। এ পর্যন্ত ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে তিনটি পুরস্কার ও আটটি মনোনয়ন পেয়েছে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চে চলচ্চিত্রের সিকুয়েল চে পার্ট টু মুক্তি পায়।
কেএসকে/জেআইএম