সেলিনা হোসেনের লেখা বই প্রথম হাতে আসে একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। সম্ভবত ২০০৬ সালে। বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে পড়ি তখন। বইটির নাম ‘টানাপোড়েন’ (১৯৯৪)। মানবিক ট্র্যাজেডির উপাখ্যান। মানবজীবনের সম্পর্ক-জটিলতার গল্প। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনি। বাহাত্তর বছর বয়সী হাশেমের পরিবার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। একজন মানুষের একা হয়ে যাওয়া কিংবা স্বার্থের টানে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এ উপন্যাসের উপাদান। সেলিনা হোসেনের সেই প্রথম পাঠই আমাকে আন্দোলিত করেছিল। মুগ্ধ হয়েছিলাম সেলিনা হোসেনের লেখায়।
Advertisement
সেলিনা হোসেন বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি। আমি তাকে বলি জীবনজয়ী কথাশিল্পী। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। সাদাসিধে জীবনের অধিকারী মানুষটি পাঠককে দেখিয়েছেন রঙিন জগৎ। পাঠকের মনে জাগিয়ে তুলেছেন রঙিন স্বপ্ন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি স্বতন্ত্র নাম। একটি মূল্যবান পরশ পাথর। যে নামটি শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয় পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের পাশাপাশি অন্য ভাষার অগণিত পাঠকের কাছে। যে পাথরের স্পর্শে আলোকিত হয় বিশ্বসাহিত্য।
ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখালেখির সূচনা সেলিনা হোসেনের। তিনি বিভিন্ন পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির ‘গবেষণা সহকারী’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিশ বছরেরও বেশি সময় সম্পাদনা করেন ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা। বর্তমানে একই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৪ সালে অবসরের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ‘সংবাদ প্রকাশ’ নামের একটি নিউজ পোর্টালের সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
আমরা জানি, প্রত্যেক লেখকেরই একটি প্রস্তুতি পর্ব থাকে, সেলিনা হোসেনেরও ছিল। তবে তিনি লেখালেখির সূচনায় গাদা গাদা বই পড়ে লিখতে বসেননি। বাড়িতে বিচিত্র বিষয়ের বই থাকলেও তার ঝোঁক ছিল প্রকৃতি দেখা, ঘুরে বেড়ানো এবং মানুষ দেখা। এই প্রকৃতি দেখা ও মানুষ দেখাকে তিনি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। সেজন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তার তেমন কিছু পড়ার সুযোগ হয়নি ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত। অভিজ্ঞতা থেকেই তার লেখালেখির ভিত শুরু। তারপর কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৩-১৯৬৪ সালের দিকে অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ নানাভাবে তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন পড়া থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যের নানা কিছু আত্মস্থ করেছেন সে সময়ে। আবার দেশীয় সাহিত্য পড়ার সূচনা তখন। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার এখনো মনে আছে, ঠিক ছোটবেলায় নয়, কলেজে ওঠার পর রাবেয়া খাতুনের ‘মধুমতি’ বেগম পত্রিকায় ছাপা হতো। পত্রিকাটি বাসায় আসতো, আম্মা রাখতেন। রাজশাহীতে আমরা আসার পরে পত্রিকা রাখা শুরু হয়, বাবার চাকরিসূত্রে বগুড়ায় থাকার সময় সেটা সম্ভব হতো না, কারণ ওটা একদম গ্রাম ছিল। তাই বইপত্র পড়ে লেখক হওয়ার প্রস্তুতি আমার হয়নি। কিন্তু আমি মনে করি, আমার শৈশবটি ছিল একটি আশ্চর্য সোনালি শৈশব। এই শৈশবে আমি প্রকৃতি এবং মানুষ দেখেছি। মাঠেঘাটে, নদীতে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর এক অবাধ স্বাধীনতা ছিল আমার। আর মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই সব কিছুই আমাকে লেখালেখিতে আসার প্রেরণা দিয়েছে।’ (সাক্ষাৎকার, মিল্টন বিশ্বাস, জাগো নিউজ, ২০২০)
Advertisement
মনোজিৎকুমার দাস তার ‘সেলিনা হোসেনের গল্প, উপন্যাসে সমকালীন দ্বন্দ্ব ও সংকটের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বাঙালি লেখকদের সৃষ্টিশীলতায় বাংলা সাহিত্য আজ চরমভাবে ঋদ্ধ। সেলিনা হোসেন এমনই একজন বাঙালি লেখক যিনি লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে ঋদ্ধতার চরম স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনি তার মেধা, মনন, চিন্তা চেতনা, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অবদান রেখে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠত করতে সক্ষম হয়েছেন।’ তবে সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে ফুটে উঠেছে মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-সংকট। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তার লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর গল্প-উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা চল্লিশের উপরে, গল্পগ্রন্থ ১৬টি, শিশু-কিশোর গ্রন্থ ৩৫টি এবং প্রবন্ধের বই ১৫টি। ভ্রমণকাহিনি রয়েছে একটি। এ ছাড়াও ১৩টি সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুন: সমরেশ মজুমদার: প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। যেটি অবলম্বনে পরে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির চেয়ে উপন্যাসকেই আমার কাছে বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছে। কারণ কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র রূপায়ন ও সমকালীনতা ফুটিয়ে তুলতে উপন্যাসের আবহকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি সিনেমাটি। হাঙর নদী গ্রেনেড তাঁর লেখা প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের পটভূমি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জের একজন মা দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে তাঁর নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। গল্পটি পাঠক এবং দর্শককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এ ছাড়া ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাস অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
তাই বলা যায়, ‘বাংলা কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন প্রকৃতভাবে একটি নিজস্ব পরিধি কিংবা বলা যায় একটি বৃত্তকাঠামো তৈরি করেছেন নিজ পারঙ্গমতায়। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি কখনো নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভুলে যাননি, উপেক্ষা করেননি। তাই আমরা তার রচনায় সামাজিক অঙ্গীকার, পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা, প্রগতিশীল মানসিকতা এবং শিল্পের সহনশীলতা, নারীর ব্যক্তিক এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বের গভীর স্বাধীনতা উপভোগ করি নান্দনিকতায়। তার শৈল্পিক চেতনায় সবসময় ইতিহাসের দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ। ইতিহাসের সঙ্গে সময়কে উপভোগ্য করে সাহিত্যিক পথচলার নতুন সড়ক নির্মাণ করেছেন।’ (সেলিনা হোসেন: কত আপনজন, বিভুরঞ্জন সরকার, বিডিনিউজ, ২০১২)
Advertisement
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বলছে, ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে দুই সেমিস্টারে পাঠ্য ছিল ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। পরবর্তীতে হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদ করেন বাংলাদেশ থেকে জ্যাকি কবীর। সেই পাণ্ডুলিপি পরিমার্জন করেন প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচারের অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি ‘রিভার অব মাই ব্ল্যাড’ নামে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়। হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে তিনটি চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি চেয়ে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে ছবিটি নির্মাণ করতে না পারার কারণে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম হাঙর নদী গ্রেনেড চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।
এছাড়া সেলিনা হোসেনের ‘নারীর রূপকথার গল্প’ উড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে উড়িষ্যা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা ‘মোহিনীর বিয়ে’ মালায়ালাম ভাষায় অনূদিত হয়ে ২০০১ সালে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’। গায়ত্রী সন্ধ্যায় সেলিনা হোসেন সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়কে তুলে ধরেছেন। এ উপন্যাসে নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এগারো দফা, গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণানা করা হয়েছে। দেশভাগ এবং বৈষম্যের শিকার একটি সাধারণ পরিবারের কাহিনি ও দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ববাংলার জীবনচিত্র নিয়ে তার ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসটি রচিত। যাপিত জীবন উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত একটি উপন্যাস। এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্ট্যাডিজ ডিপার্টমেন্টে বাংলা বিভাগে তার দুটি গল্পও পাঠ্য। ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়, কোচবিহার ইউজিসি পাঠ্যক্রমে ‘আমিনা মদিনার গল্প’ পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫টি কলেজ রয়েছে। ২০১৮ সালে ‘কাঠকয়লার ছবি’ উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়। কাঠকয়লার ছবি একটি লস্ট আইডেনটিটির গল্প। উপন্যাসটি একাত্তরের যুদ্ধশিশু এবং সিলেটের চা শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে লেখা। কাঠকয়লার ছবি উপন্যাসটি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতেও পাঠ্য করা হয়েছে। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নারীনেত্রী ইলামিত্রকে নিয়ে লেখা তার অসাধারণ উপন্যাস ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগে সেলিনা হোসেনের ‘ঘরগেরস্থের রাজনীতি’ বইটি পাঠ্য করেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, তিনি আর বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নন। পৌঁছে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের দরবারেও।
তার গল্প-উপন্যাসে নারী চরিত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ সম্পর্কে তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি আমার গল্প-উপন্যাসে নারী ভাবনাকে অনেক বেশি খেলামেলা দৃষ্টিতে দেখেছি। আমার গল্প-উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা, সমাজবৃত্তের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লড়াই করা নারী। আমার প্রথম দিককার উপন্যাস ‘পদশব্দ’। এ উপন্যাসে দুটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্রটি সালমা—যে বাবাকে স্টাবলিশমেন্টের প্রতিনিধি মনে করেছে এবং বাবার সততা ও নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অন্যদিকে আর একটি চরিত্র নাসিমা—যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। গণ্ডিকে চ্যালেঞ্জ করে লিভ-টুগেদার করে। ১৯৭৪ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। ৬০-এর দশকের মধ্যভাগে আমার লেখার গুরুত্বে আমি নারীর ব্যক্তিক সংকট, মনস্তাত্ত্বিক সংকট ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তুলে এনেছি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। (সাক্ষাৎকার, মিল্টন বিশ্বাস, জাগো নিউজ, ২০২০)
আরও পড়ুন: ওবায়েদ আকাশের কবিতা: উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল ভাষা
লেখালেখি ছাড়াও তিনি প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। তিনি যে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা স্বীকারও করেছেন এক সাক্ষাৎকার। তিনি বলেছেন, ‘তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা করে দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে রাজনীতির পাঠ শেষ করে দিই, শুধু লেখালেখির জগৎ ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখায়। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্ট কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে। বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধকে রাষ্ট্র সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানা দিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ এটাই আমার গভীর বিশ্বাস।’ (সেলিনা হোসেন: কত আপনজন, বিভুরঞ্জন সরকার, বিডিনিউজ, ২০১২)
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানাভাবে তার লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লেখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এ বিষয়ে উপন্যাস লেখেন। নানা বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও তাঁর দুটি উপন্যাস ‘যাপিত জীবন’ এবং ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ প্রকাশ হয়। বলতে গেলে, সেলিনা হোসেনের লেখা বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তার লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ ও মানবিকতা। নিজের লেখালেখি নিয়ে সেলিনা হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মানব-মানবীর সম্পর্ক, নারী-পুরুষ তথা মা-মেয়ে, মা-বাবা, বাবা-ছেলে প্রভৃতি সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতা বিচিত্র প্রভাব রেখেছে আমার লেখাজোকায়, আর এসব সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গল্প লিখেছি আমি।’
লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতি ও মানুষকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ হলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্পচর্চা শুরু করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মনে করেন, ‘লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।’
সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাকে নিয়ে বহুবিধ গবেষণার দাবি রাখে। ড. নাসরীন জেবিনের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ঐতিহ্য ও শিল্পরূপ’ একটি পরিশ্রমলব্ধ গবেষণা। তাঁর জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে আরও গবেষণা হতে পারে। আমি মনে করি, এখনই উত্তম সময়। তাই দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে গবেষণা হলে হয়তো নিজের জন্মের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমরাও তাঁকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা জানানোর সুযোগ পাব। এ কথা সত্য যে, যদিও গবেষণা আপেক্ষিক বিষয়; তারপরও যুগ যুগ ধরে তিনি গবেষণার পাত্র হয়ে থাকবেন।
বিশিষ্ট এ কথাসাহিত্যিক উপন্যাসে বিশেষ অবদানের জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন ১৯৮০ সালে। ভাষা ও সাহিত্যে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন ২০০৯ সালে। ‘সার্ক সাহিত্য পুরস্কার’ পান ২০১৫ সালে। সাহিত্যে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পান ২০১৮ সালে। এ ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। আমি তার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি। জীবনজয়ী মহান এ কথাসাহিত্যিকের লেখা আরও ছড়িয়ে পড়ুক। জীবনের যত দুঃখ ঘুচে যাক সৃষ্টির আনন্দে।
এসইউ/এমএস