জাগো জবস

গ্রোথ মার্কেটিংয়ে অপার সম্ভাবনা আছে: মেহজাবিন বাঁধন

মেহজাবিন বাঁধন একজন গ্রোথ মার্কেটিং কনসালটেন্ট। কর্পোরেটের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ মানুষটি ভীষণ পরিশ্রমী। যে কারণে দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন নানা সময়ে। বর্তমান কাজ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণদের জন্য রয়েছে তার পরামর্শ। সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন—মেহজাবিন বাঁধন: আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবই ঢাকায়। এসএসসি ছিল মতিঝিল সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। কলেজ ছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ইউনিভার্সিটি ছিল ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। সেখানেই আমার বিবিএ শেষ করি মার্কেটিং মেজর নিয়ে। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। আমি সবার বড়। একটা ছোট ভাই ও বোন আছে। মূলত বড় হয়েছি বড় খালার ছেলে-মেয়েদের কাছে। বড় খালা একজন কবি, সাহিত্যিক; আমার মা-ও একজন লেখক। তাই আমার জীবনধারা, আচার-আচরণ মোটামুটি বড় খালা আর ছেলে-মেয়েদের দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে পরিবার থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ: কর্মজীবনের গল্প শুনতে চাই—মেহজাবিন বাঁধন: আমি ইস্ট ওয়েস্টে স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়ই বড় কাজিনের আইটি ফার্ম বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেডে কাজ করতাম। ওই ফার্ম তখন সব ফরেইন ক্লায়েন্ট ডিল করতো। সেখান থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং, এসইও, পিপিএম, প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে জানি এবং শিখি। এটি ২০১২ সালের কথা। ই-কমার্স তখন ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডেই মোটামুটি নতুন। গুগলও তখন এত পপুলার ছিল না।

সেখানে নানা রকম কাজ করতাম। সবচেয়ে বেশি শিখেছি লিডারশিপ এবং এক্সিকিউটিভ ডিসিশন মেকিং প্রসেস। একটি বিজনেস শূন্য থেকে শুরু করতে হলে কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে রিসোর্স এলোকেশন করতে হয়। বিজনেসটি যখন বড় হয়ে যায়, টিম যখন ৫ জন থেকে ১০০ জনের হয়; তখন কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে ডিসিশন নিতে হয়। বলা যায়, আমার লার্নিংয়ের একটি বড় শেপ আপ হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানে। তারা মূলত ফরেন ক্লায়েন্টদের কাজ করতেন। মোটামুটি সবই ইউএস, ইউকে, অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ী। আমার সব সময় ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশ মার্কেটে কাজ করার। বাংলাদেশ কনজ্যুমার ডিসিশন মেকিং প্রসেস, বাংলাদেশ বিজনেস ডায়ানামিক্স নিয়ে কাজ করার। তাই ২০১৪ সালে বিট মাসকট ছেড়ে গ্রামীণ ফোনে ইন্টার্নশিপ করি।

Advertisement

আরও পড়ুন: ডেইরি ফার্ম করে সফল মেহেরুন্নেছা

ইন্টার্নশিপ শেষে ম্যাক্সিস টায়ার বাংলাদেশে জয়েন করি। সেখানে জয়েন করে বুঝতে পারি, আমরা ৪ বছর যা শিখেছি, পড়েছি; ইন্ডাস্ট্রি আসলে তার চেয়ে কত আলাদা। এটি আমার জন্য বিশাল ধাক্কা ছিল। এখানে মূলত বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, পিয়ার ম্যানেজমেন্ট এবং ইভেন্ট অ্যাক্টিভিশন নিয়ে কাজ করতে হতো। আমার তখনকার বস নর্থ সাউথ থেকে পড়াশোনা করা ছিল। বাংলাদেশ ডায়নামিক্স যে কীভাবে কাজ করে, তিনি প্রায় আমাকে গাইড করতেন এ ব্যাপারে।

জাগো নিউজ: কাজ করতে গিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?মেহজাবিন বাঁধন: এমনিতেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, সাকসেস মোটামুটি ৮০% ডিপেন্ড করে ডিলার ম্যানেজমেন্ট এবং ডিস্ট্রিবিউশনের ওপর। এখানেও যে একটু অন্যভাবে চিন্তা করে বিজনেসে গ্রোথ আনা সম্ভব, এটি ছিল আমার সেখানকার বড় লার্নিং।

জাগো নিউজ: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?মেহজাবিন বাঁধন: ম্যাক্সিস টায়ার বাংলাদেশে কাজ করার পর আরএসপিএল নামের একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। এফএমসিজি প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুবাদে সেখানে মূলত সরাসরি কাস্টমারদের জানার সুযোগ পাই। তারা যখন একটি ডিশিনন নেন, কেন নেন, কী চিন্তা করেন, কী কী ফ্যাক্টর দ্বারা ডিসিশন ইনফ্লুয়েন্সড হয়, তাদের ডিসিশন মেকিং প্রসেস আসলে কতটা লোকাল বিজনেস ডায়ানমিক্স, জিও পলিটিকাল ইস্যু, রিলিজিয়াস ইস্যু, পিয়ার প্রেশার এবং মার্কেটিংয়ের ৪ পি দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড, ওটা খুব কাছ থেকে জানার এবং বোঝার সুযোগ পাই।

Advertisement

সেখান থেকে চলে আসি এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেডে (স্বপ্ন)। এটি আবার একটি রিটেইল কোম্পানি। এখানে প্রায় ৪ বছর ছিলাম। আমি যদি নিজের এক্সপেরিয়ান্স বলি, বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভে রিটেইলের কাজের ডেপথ অনেক বেশি। কিন্তু ব্রেডথ অনেক কম। যেমন বাসার কাছের ১০০টি মুদি দোকান, বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং শপিং মলে যা বিক্রি হচ্ছে, একটি সুপারশপে মোর অর লেস তা-ই বিক্রি হচ্ছে। তার মানে একটি স্টোরের সেলস বাড়ানোর জন্য ওই ১০০ জন রিটেইলার যা যা ভ্যালু ওভার করছে, একটা স্টোরকে ঠিক ওই ভ্যালু কিংবা তার চেয়ে বেশি ভ্যালু দিয়ে কাস্টমার অ্যাকুইজিশন এবং রিটেনশন করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ই-কমার্স নির্দেশিকায় কী আছে কী নেই

এখানে আমার মেইন লার্নিংটা ছিল এটাই। বাংলাদেশের ফ্রেশ প্রোডাক্ট, টোটাল কমোডিটি এবং এফএমসিজি মার্কেটের ৪-৫% মাত্র রিটেইল, ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স কন্ট্রিবিউট করে। বাকি পুরোটাই আসে ট্র্যাডিশনাল সেটআপ থেকে। আবার আমি যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই ওখানে প্রায় ৭০-৮০ ভাগই কন্ট্রিবিউট করে মর্ডান ট্রেড। তাই বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভে যে কাস্টমার কাচা বাজারে যাচ্ছেন, যে বাসার কাছের মুদি দোকানে যাচ্ছেন; তিনিই কোনো সুপার শপে আসছেন। কিন্তু সুপার শপে আসার সাথে সাথে তার এক্সপেক্টেশন, সেন্সিটিভিটি, অ্যাটিটিউড, প্রেফারেন্সেস পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।

এখানে যখন প্রথম জয়েন করি; তখন আমার কাজ ছিল কমপ্লেইন্টসগুলো কেন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করে ওই ইস্যু যেন আর না আসে, এমন একটি মডিউল ডেভেলপ করা। তো এই কাজ করতে গিয়ে আমি প্রচুর কাস্টমারদের সাথে কথা বলতাম। আমার মনে আছে, আমি প্রতিটা কাস্টমার অভিযোগকারী কাস্টমার এবং যারা অভিযোগ করতো না, তাদের সাথে কথা বলতাম। যেহেতু আমি ট্র্যাডিশনাল রুট টু মার্কেট মডেলে কাজ করে আসছি, আই মিন জেনারেল ট্রেড নিয়ে কাজ করেছি। তাই আমার জন্য রিটেইলের কাস্টমারদের পালস বোঝাটা অনেক সহজ ছিল। যেমন কাঁচা বাজার থেকে কেনা মাছের কোয়ালিটি যদি খারাপ হয়, তাহলে একজন কাস্টমার ফেসবুকে বড় করে পোস্ট দেন না। কিন্তু কোনো সুপার শপ কিংবা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে কিনলে কেন দেন, এই যে ব্যাপারটা এটার আসলে কারণটা এবং এটা কীভাবে ট্যাকেল করতে হবে, তা ছিল আমার প্রথম লার্নিং।

স্বপ্নে প্রচুর প্রজেক্ট এবং এক্সপেরিমেন্টেশন রান হয় রেগুলার টাস্কের পাশাপাশি। যেহেতু আমি কাজ করা এবং শেখার ব্যাপারে প্যাশনেট ছিলাম। তাই প্রচুর প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। দেখা গেছে, আমি প্রায় প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের সাথেই কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কাস্টমার সার্ভিস থেকে শুরু করে মার্কেটিং, প্রকিউরমেন্ট, অপারেশন, সেলস, ক্যাটাগরি এমনকি সাপ্লাই চেইনেও। প্রথমে কাস্টমার সার্ভিস দিয়ে শুরু করলে পরে মার্কেট অ্যানালিটিক্স, সিআরএম, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, চ্যানেল ডেভেলপমেন্টের হেড হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি।

জাগো নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে গ্রোথ মার্কেটিংয়ের সম্ভাবনা কেমন?মেহজাবিন বাঁধন: আমার প্যাশনের জন্যই হোক আর আমার স্কিল কিংবা এক্সপেরিয়েন্সের জন্যই হোক, আমি বিশ্বাস করি মার্কেটে কাজের স্কোপ, ইনোভেশনের স্কোপ আছে। তবে এ স্কোপ খুঁজে বের করার জন্য নিজের চোখ দিয়ে মার্কেটকে না দেখে একটু কাস্টমারের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। তাহলে অনেক ডাইমেনশন বোঝা যায়। আমার উদ্দেশ্য, এ মুহূর্তে যাদের সাথে কাজ করছি, তাদের ১ বছরের মধ্যে অন্তত ফোর টু ফাইফ টাইমস গ্রোথ নিয়ে আসা। আমি বিশ্বাস করি, এটা খুব কঠিন কিছু নয়। আমি বিশ্বাস করি, গ্রোথ মার্কেটিংয়ে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন: ই-কমার্সে এসক্রো সিস্টেম আসলে কী?

জাগো নিউজ: তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?মেহজাবিন বাঁধন: তরুণদের জন্য কথা হচ্ছে, বাঁচতে হবে নিজের জন্য। নিজের স্বপ্নের জন্য বাঁচতে শিখতে হবে। আমরা অনেক বেশি অন্যের জন্য বাঁচি। এ কারণে নিজের মধ্যে একটা হাহাকার দেখা যায়। কাজের ইচ্ছা কমে যায়। জীবনের প্রতি বিরক্তি চলে আসে। ফ্রাস্ট্রেশন বা ডিপ্রেশন ভর করে। তাই নিজের জন্য বাঁচতে হবে। নিজের জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন পূরণের জন্য ধৈর্য, কঠিন পরিশ্রম, লেগে থাকা এবং মাইন্ডসেট রাখতে হবে।

জাগো নিউজ: একজন সেলস পেশাজীবীর জন্য কী পরামর্শ দেবেন?মেহজাবিন বাঁধন: সেলসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘Skill of Persuasion’। এ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিজেকে এবং অপরপক্ষকে বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য মূলত দু’ধরনের জিনিসই বোঝা দরকার। এখানে একটি পার্ট টেকনিক্যাল নলেজ যেমন- প্রোডাক্ট নলেজ, কাস্টমার নলেজ, কম্পিটিটর নলেজ, ইন্ডাস্ট্রিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার নলেজ, আপনি যেই প্রোডাক্ট সেল করতে যাচ্ছেন, সেটি আসলে কাস্টমারের কী কী সমস্যা সমাধান করবে ইত্যাদি। আরেকটি পার্ট হচ্ছে সফট, যেমন- কমিউনিকেশন স্কিল, নেগোসিয়েশন স্কিল, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, টাফ সিচুয়েশন কিংবা নেগেটিভ সিটুয়েশন হ্যান্ডেল করার ক্যাপাসিটি, নিজের পজিটিভিটি ধরে রাখার ক্যাপাসিটি।

এসইউ/এমএস